ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আল্লামা শফীর পর কে?

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

আল্লামা শফীর পর কে?

ইউনুস মিয়া, হাটহাজারী থেকে ॥ হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহলে নানা বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এরমধ্যে একদিকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর হাল ধরা এবং অপরদিকে ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসাকে সুচারুরূপে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি। গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে শারীরিক অক্ষমতার কারণে পরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি এবং তার ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার ভেতরে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু বিজয়ের পরমুহূর্তে মাদ্রাসার যিনি ছিলেন দীর্ঘ সময়ের প্রাণ তার ইন্তেকালে আগামীতে পরিস্থিতি কি হতে যাচ্ছে তা-ই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। দেশজুড়ে কওমি মাদ্রাসা এবং সমর্থক, হেফাজতে ইসলাম ও এর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন শতবর্ষী আলেম আল্লামা আহমদ শফী। তিনি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকেরও প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি হাটহাজারীর এ মাদ্রাসার আন্দোলনের ঢেউ লাগে দেশের সবক’টি কওমি মাদ্রাসায়। মূলত কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাক-এ নানা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি নিয়ে ফুঁসে উঠে কওমি অঙ্গন। বেফাকুল মাদারিসিল আরবিয়া বাংলাদেশ সংক্ষেপে (বেফাক) দেশের সকল কওমি মাদ্রাসা দেখভাল করে। পুরোদেশে কওমি মাদ্রাসা রয়েছে প্রায় ২২ হাজার। আর শিক্ষার্থী রয়েছে ২৫ লক্ষাধিক। এই বেফাকের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এখন কওমি ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। বেফাকের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশকিছু অডিও ফাঁস হয়। এরপর থেকেই উত্তেজনা ছড়াতে থাকে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মেধা তালিকা নিয়ে জালিয়াতি, বেফাকের খাস কমিটি বাতিল, বেফাকের নেতৃস্থানীয় একাধিক আলেমের নামে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং সহকর্মীদের নামে নানা দুর্নাম রটানোসহ আরও অনেক কিছু আলোচনায় আসে। এরই প্রেক্ষিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফসহ তিনজনকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে বেফাক। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা সদস্য মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ও মাওলানা নুরুল আমিন যথাক্রমে বেফাকের মহাসচিব ও সহকারী মহাসচিব। তারা আল্লামা আহমদ শফীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এই বোর্ডের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। বছরের পর বছর পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন গুটিকয়েকজন। এতে করে বাড়ছে দুর্নীতি, কমছে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। শিক্ষার্থীদের এত ক্ষোভ যে কারণে ॥ গত ১৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করে হাটহাজারী মাদ্রাসায় আনাস মাদানীকে অপসারণসহ নানা দাবিতে আন্দোলনে নামে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ-কওমি মাদ্রাসার সরকারী স্বীকৃতি একটি অধিকার। কিন্তু এর বাহবা নেয়ার মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার সুনাম ক্ষুণœ করা হচ্ছে। সংগঠনের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকলেও তার ধারে-কাছে নেই নেতারা। সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করে সুবিধা হাসিলে ব্যস্ত কওমি অঙ্গনের অনেক আলেম ওলামা। বেফাক, হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের আমানতের খেয়ানত করে আসছে এসব অসাধু ব্যক্তিরা। মুরুব্বি নামক একতরফা স্বৈরাচারী ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বেফাকের ওপর জবরদখলের সংস্কৃতির চর্চা করার অভিযোগও আনেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবি- এতে করে কওমি মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ ও বহিষ্কারে স্বজনপ্রীতি, সাধারণ নিরীহ ওস্তাদ ও ছাত্রদের ওপর আনাস মাদানীর নির্যাতন ও অধিকারহারা করার অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের যে ৫ দাবি ॥ আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করতে হবে। ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে। আল্লামা আহমদ শফী শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ায় পরিচালক পদ থেকে সম্মানজনক অব্যাহতি দিয়ে উপদেষ্টা বানাতে হবে। ওস্তাদের পূর্ণ অধিকার ও বিয়োগ-নিয়োগকে শূরার নিকট পূর্ণ ন্যস্ত করতে হবে। বিগত শূরার হক্কানি আলেমদের পুনর্বহাল এবং বর্তমান শূরার বিতর্কিত সদস্যদের বাদ দিতে হবে। সূত্র মতে, গঠনতন্ত্রে বেফাকের মজলিসে শূরার সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২১ জন পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে কমিটির ব্যাপ্তি ১৫৫ জনে। এরমধ্যে দায়িত্বশীল পর্যায়ে এক মাদ্রাসা থেকে রয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে নেতৃস্থানীয়রা প্রভাব বিস্তার করতে কমিটিতে নিজেদের লোককে জায়গা করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কমিটিতে এলাকাপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগও রয়েছে। এমনকি বেফাক প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছর পর্যন্ত বেফাকের কর্মনীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আসা এবং বেফাকে নিজ নিজ মাদ্রাসা থেকে অন্তর্ভুক্ত করানো পরিচালকরা বেফাকে যোগ দিয়েই পেয়েছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ। প্রভাব প্রতিপত্তি ॥ ১৫ বছর ধরে বেফাকের সভাপতি ছিলেন আল্লামা আহমদ শফী। অভিযোগ রয়েছে, তিনি যখন প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০০৫ সালে তখনও তার হাটহাজারী মাদ্রাসা বেফাকের আওতাভুক্ত হয়নি। দ্বীনি শিক্ষায় স্বজনপ্রীতির বিরোধিতা করা হলেও এ ধরনের চর্চা দেশের সবচেয়ে বড় কওমি প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধাগ্রস্ত করেছে। যার কারণে ছাত্রদের, ক্ষোভ ক্রমশ দানা বেঁধে আসছিল। রুদ্ধশ্বাস ৩৬ ঘণ্টা ॥ গত বুধবার জোহরের নামাজের পর হঠাৎ করেই হাটহাজারী মাদ্রাসার মাঠে জড়ো হতে থাকে ছাত্ররা। কিছুক্ষণের মধ্যে মাদ্রাসার প্রায় কয়েক হাজার ছাত্র জড়ো হয়ে মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক মাওলানা আনাস মাদানীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে এবং মাদ্রাসার প্রধান ফটকসহ সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। মাদ্রাসার চারপাশে শিক্ষার্থীরা মাথার পাগড়ি দিয়ে, মুখে মাস্ক পরে লোহার রড, হকস্টিক, লাঠিসোটা নিয়ে পাহারা দিতে শুরু করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা মসজিদের মাইক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এভাবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা ওই সময়ে ঘোষণা দেয় যে, ‘আমাদের এই আন্দোলন একান্তই মাদ্রাসা বিষয়ক, তাই প্রশাসন ও এলাকাবাসী যেন মাদ্রাসায় হস্তক্ষেপ না করে’। যার কারণে প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করে মাদ্রাসার বাইরে সতর্ক অবস্থান নেয়। কে হবেন মাদ্রাসার পরিচালক ॥ হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এই মাদ্রাসার পরিচালক কে হবেন- এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান নিয়ম অনুযায়ী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি মজলিশে শূরাই সিদ্ধান্ত নেবে মাদ্রাসা পরিচালক কে হবেন। সূত্র মতে জানা গেছে, মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, বর্তমান সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ, মুফতী জসীম উদ্দীন এ ৩ জনের মধ্যে যে কোন একজনকে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন চলছে। হেফাজতের আমির কে হচ্ছেন ॥ হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ মূলত হাটহাজারীর এ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। সমস্ত কর্মকা-ের দিক-নির্দেশনা এ মাদ্রাসা থেকেই দেয়া হয়ে থাকে। ফলে এ মাদ্রাসার যিনি মুহতামিম পদে থাকেন তিনিই মূলত হেফাজতের আমিরের পদেও অধিষ্ঠিত হন। আল্লামা আহমদ শফীও ছিলেন অনুরূপ। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে তিনি মাদ্রাসার মুহতামিমের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে হেফাজতে আমিরের পদে তিনি ঠিকই আসীন ছিলেন। কিন্তু মুহতামিমের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার ইন্তেকাল ঘটে। ফলে হেফাজতের আমিরের পদটিও এখন শূন্য। হেফাজতের মূলত কোন সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র নেই। তবে পরিচালনার জন্য কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। এক্ষেত্রে এমনটিই ধরে নেয়া হয় যিনিই হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম পদে থাকবেন তিনিই হবেন হেফাজতের আমির। মাওলানা শফীর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্নতর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। সঙ্গত কারণে হেফাজতের শীর্ষ পদটিতে কাকে বসানো হচ্ছে সেটি নিয়েও জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু হেফাজত একটি অরাজনৈতিক দল হিসাবে ঘোষিত কিন্তু এরপরও এ সংগঠনটির ধর্মভিত্তিক প্রভাব দেশের অঙ্গনে ইতোমধ্যে আলোচনায় চলে এসেছে। বিশেষ করে ইসলামপন্থী দলগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে হেফাজতের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এছাড়া অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি তো রয়েছেই। ফলে এখন দেখার বিষয় হেফাজতের নেতৃত্ব কার হাতে যাচ্ছে। হেফাজতের মধ্যে দুটি ধারা রয়েছে। এরমধ্যে একটি কট্টরপন্থী, আরেকটি সর্বদা সহিংস পরিস্থিতিতে থাকার বিষয়টিকে সমর্থন করে। আবার এ দুই ধারার মধ্যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থন দিয়ে থাকে এ কারণে যে, বহুকাল পরে হলেও এ সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে মাইলফলক স্থাপন করেছে। যে কারণে তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি জননী নামে ভূষিত করেছেন।
×