ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোই লক্ষ্য

প্রকাশিত: ২২:২২, ৮ জুলাই ২০২০

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোই লক্ষ্য

রহিম শেখ ॥ গত কয়েক বছর দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ান। সে লক্ষে বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। কিন্তু মহামারী করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। ভাটা পড়েছে বেসরকারী বিনিয়োগে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ। এ দুটি চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাকালীন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নতুন মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। চলতি মাসের শেষের দিকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারী বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ এবং বেসরকারী বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ ৩ মাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায়। এ কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে আনা হয়। সংশোধিত বাজেটে মোট লক্ষ্য ধরা হয় ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ ৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ করা হয়। আর বেসরকারী বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ শতাংশ কমিয়ে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে দেশে ব্যক্তি উদ্যোক্তা খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর মধ্যে সরকার চলতি অর্থবছরে আরও অতিরিক্ত ৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে বলে আশা করছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থায় প্রায় ১ লাখ ৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। সরকার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণের ঋণ নিলে স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ আরও কমবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে প্রাণঘাতী করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের কর্মসংস্থান। কর্মহীন বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দরিদ্র মানুষ বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির প্রতিবেদন উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম সুস্তফা কামাল বাজেট ঘোষণায় বলেছেন, শুধু করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছে ১৪ লাখ মানুষ। ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি, কলকারখানা বন্ধ থাকা এবং সর্বোপরি ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। যদিও করোনায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানে উৎপাদনশীল খাত চালু করা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ। করোনাকালীন এমন সঙ্কটের মাঝে ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবছর মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নেয়া হয়। এবারও মতামত নেয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে করোনার কারণে এবার সংশ্লষ্ট অংশীজনদের নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনাসভার আয়োজন করা থেকে বিরত থাকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিবর্তে ই-মেলে মতামত নেয়া হচ্ছে। আর সর্বধারণের মতামত নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। মঙ্গলবার ছিল মতামত দেয়ার শেষ দিন। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নতুন মুদ্রানীতির মূল ফোকাস হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক উভয় চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিতে হবে। মন্দার যে প্রভাব দেশের রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর পড়ছে এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা মোকাবেলা করার পদক্ষেপ থাকতে হবে। এ জন্য সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি দিতে হবে, যাতে বিনিয়োগ বাড়ে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে মোট অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারী খাতে ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, আর সরকারী খাতে ধরা হয় ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি রাখা হয় পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশে। এরপর চলতি বছরের গত জানুয়ারি মাসে মুদ্রানীতিতে সংশোধনী আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিবর্তিত মুদ্রানীতিতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৭ দশমিক ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। সরকারী খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি করে এটি করা হয়। পরিবর্তিত মুদ্রানীতিতে ঘোষিত সরকারী খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে উন্নীত করে ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়। যদিও মহামারী করোনার আগে থেকেই বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়ছে ধীরগতিতে। করোনার পর থেকে এই গতি আরও মন্থর হয়ে পড়েছে। এমনকি করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণেও তেমন গতি নেই। এতে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বেসরকারী খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ তলানিতে নেমে গেছে। পুরো অর্থবছরে ১৪.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত মে পর্যন্ত বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮.৮৬ শতাংশ; যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ বিষয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজেটে ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে বেসরকারী খাতে। যদিও বেসরকারী খাতে ঋণ চাহিদা রয়েছে, কিন্তু ব্যাংকগুলো দিতে পারছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাকালে নতুন মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমুখী হওয়া লাগবে। যাতে টাকার অভাবে কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আটকে না থাকে। এ জন্য পুনরর্থায়ন তহবিলের মাত্রা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। এ ছাড়া সরকার ঘোষিত প্রণোদনামূলক যেসব প্যাকেজ আছে, সেগুলো থেকে ঋণ বিতরণ হচ্ছে কি না সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে মনিটরিং অব্যাহত রাখতে হবে।
×