ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কেন কোচের ছুটির ব্যাপারে সবসময়ই এত উদার?

ফাঁক পেলেই দেশে চলে যান জেমি

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

ফাঁক পেলেই দেশে চলে যান জেমি

রুমেল খান ॥ বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘নেই কাজ তো খই ভাজ।’ বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচের (বেশিরভাগ সময় তিনি বিদেশী হন) বেলাতেও এমন একটা প্রবাদ অনায়াসেই ব্যবহার করা যেতে পারে, ‘নেই খেলা তো ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে কাটাও বেলা।’ বাংলাদেশ দলের বর্তমান হেড কোচ জেমি ডে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষ হতে না হতেই যথারীতি তিনি ছুটি নিয়ে উড়ালপঙ্খীতে চড়ে উড়াল দিয়েছেন নিজ দেশ ইংল্যান্ডে। ফেরার কথা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ শুরুর একদিন আগে (লীগ শুরুর তারিখ ছিল ৩০ জানুয়ারি, কিন্তু বাফুফে সেটা পিছিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি করেছে)। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জনা তিরিশেক কোচ। এদের অধিকাংশই বিদেশী। এদের প্রায় অর্ধেকেই (১৪ জন) আবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বর্তমান সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের আমলে। সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই জানেন বাফুফে সভাপতির মসনদে সালাউদ্দিন গত একযুগ ধরে আসীন। আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য অভিপ্রায় ব্যক্ত করে ইতোমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। যাকগে, সে অন্য প্রসঙ্গ। আজকের লেখা কোচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাক। বলা হয়ে থাকে ফুটবলে অধিনায়ক কেবল নামেই অধিনায়ক, আসলে তিনি খেটে খাওয়া শ্রমিক ছাড়া কিছুই নন। আসল অধিনায়ক যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে তিনি হচ্ছেন কোচ। তার দিক-নির্দেশনায়, পরিচালনায়-পরিকল্পনায় দলের জয় বা ড্র নির্ধারিত হয়। ফুটবল দলকে যদি একটা জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে সে জাহাজের ক্যাপ্টেন হচ্ছেন কোচ। শিপ ক্যাপ্টেন এবং ফুটবল কোচের মধ্যে আরেকটি মিল আছে। জাহাজডুবি হলে দায়ী করা হয় ক্যাপ্টেনকে, তেমনি দলের ভরাডুবি ঘটলে বা সাফল্য না ফেলে বলির পাঁঠা বানানো হয় এ কোচ মহাশয়কেই। জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে বাফুফে যুগে যুগে অনেক বিদেশী কোচ এনেছে। শুরুটা হয় বেকেল হফটকে দিয়ে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তৃতীয় কোচ ও প্রথম বিদেশী কোচ ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির হফট। ১৯৭৮-১৯৮১ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় দলের। আরও চারজনের পর ১৯৯৪ সালে আসেন অটো ফিস্টার, তৃতীয় জার্মান এবং ষষ্ঠ বিদেশী কোচ হিসেবে। ছিলেন ১৯৯৭ পর্যন্ত। তার অধীনে প্রভূত উন্নতি করে বাংলাদেশ। জেতে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের (১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ) শিরোপা। ইরাকের সামির শাকির জাতীয় দলের সপ্তম বিদেশী কোচ (১৯৯৮-১৯৯৯)। তার কোচিংয়েই বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালের কাঠমা-ু সাফ গেমসে প্রথমবারের মতো ফুটবলে স্বর্ণপদক করায়ত্ত করে। ২০০০ সালে আসা অস্ট্রিয়ার জর্জ কোটানের অধীনে ২০০৩ সালের সাফ ফুটবল আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সার্বিয়ার জোরান জর্জেভিচ ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র একমাস দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তার অধীনে খেলে এসএ গেমসে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেই শেষ, এরপর আর কোন আসরের শিরোপার স্বাদ পায়নি বাংলাদেশ। অথচ এরপর গত ১০ বছর আরও দশ বিদেশী কোচ এসেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু ফলাফল অশ্বডিম্ব। সময়টা যদি আরও কমিয়ে এনে ১০ থেকে ৭-এ করা যায় তাহলে দেখা যাবে এই ৭ বছরে (লোডভিক ক্রুইফ থেকে জেমি ডেসহ মোট ছয় কোচ) কোচরা আর কিছু পারুন আর নাই পারুন, একটা কাজ তারা সফলভাবে ঠিকই করতে পেরেছেন। পাঠক নিশ্চয়ই আগ্রহী হয়ে জানতে চাইবেন কী সেটা? উত্তর : ঘন ঘন এবং দীর্ঘ ছুটি কাটানো। হ্যাঁ, শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও এটাই সত্য। আর এসব কোচের বারবার ছুটির আবেদন মঞ্জুর করে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতেই পারে দেশীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাফুফেকে। তারা কেন কোচের ছুটির ব্যাপারে সবসময়ই এত উদার? অতীতে অনেকবারই এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রতিবারই একই ‘ভাঙ্গা’ টেপ রেকর্ডার বাজিয়েছেন বাফুফে বস সালাউদ্দিন, ‘বিশ্বের কোন দেশের জাতীয় দলের কোচই সারাক্ষণই জাতীয় দল নিয়ে একটানা কাজ করতে পারেন না। কারণ ঘরোয়া লীগ, টুর্নামেন্ট মিলিয়ে প্রায় সারাবছরই খেলা থাকে ক্লাবগুলোর। ফলে জাতীয় দলের খেলা হলে ক্লাবগুলো থেকে খেলোয়াড় এনে ক্যাম্প করে জাতীয় দলের অনুশীলন খুব বেশিদিন করানোর সময় পান না কোচ।’ সালাউদ্দিনের কথা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। তবে বাংলাদেশ দলের দূর-অতীতের বিদেশী কোচদের ইতিহাস পর্যক্ষেণে দেখা গেছে তারা শুধু জাতীয় দল নয়, কাজ করেছেন যুব দল এবং বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দল নিয়েও। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ অটো ফিস্টার। অথচ গত সাত বছরে বিদেশী কোচরা সিনিয়র দল ছাড়া কেবল যুব বা অনুর্ধ-২৩ দল নিয়েই কাজ করেছেন। এটা ঠিক, জাতীয় দলের খেলা বেশি হয় না এবং লম্বা বিরতিতে হয় বলে কোচদের হাতে কোন কাজ থাকে না। কিন্তু প্রিমিয়ার লীগ বা ঘরোয়া টুর্নামেন্ট চলাকালে তারা কোন বিভিন্ন ক্লাবের খেলা ও অনুশীলন দেখতে পারেন। এগুলো দেখলে তিনি তো প্রতিভাবান ফুটবলার বেছে নিতে পারে জাতীয় দলের জন্য। অথচ জেমি ডে’কে এমনটা করতে দেখা গেছে কদাচিৎ। জাতীয় দলের ও ঘরোয়া কোন খেলা না থাকলেই সুযোগ পেলেই তিনি বায়না ধরেন ছুটি কাটানোর। আর বাফুফেও তার সেই আবদার পূরণ করে অতি সানন্দেই। কোচের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তিতেই হয়তো আছে এসব অপশন। কিন্তু ক্ষুব্ধ ফুটবলপ্রেমীদের প্রশ্ন, ‘কোন আক্কেলে বাফুফে কোচদের সঙ্গে এ ধরনের উদ্ভট চুক্তি করে?’ ২০১৯ সালে এসএ গেমস ফুটবল উপলক্ষে জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরু হলে বসুন্ধরা কিংস নিয়মের দোহাই দিয়ে তাদের আট ফুটবলারকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে পাঠাতে আপত্তি করে। এতে করে ক্যাম্প কয়েকদিন পিছিয়ে দেয় বাফুফে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জেমি ‘ফুরুৎ’ করে উড়ে যান ইংল্যান্ডে। তিনি পরে জাতীয় দলের সঙ্গে যোগ দেন, তবে ঢাকায় নয়, নেপালের কাঠমান্ডুতে। এর ফলও পায় বাংলাদেশ নগদেÑ ভারত-পাকিস্তান না থাকার পরও বাংলাদেশ সেই আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়া তো দূরে থাক, ফাইনালেই উঠতে পারেনি। কোনমতে হয় তৃতীয় (তাম্রপদক)। এবার লীগ পিছিয়ে যাওয়ার বদৌলতে আবারও একই কাজ করেছেন এই ব্রিটিশ কোচ। এমনটা তিনি এর আগেই অনেকবার করেছেন। এটা না করে তিনি কি ক্লাবগুলোর প্রস্তুতি দেখতে তাদের অনুশীলন দেখতে পারতেন না? বাংলাদেশের বিদেশী কোচদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছুটি কাটানোর সৌভাগ্যবান ব্যক্তি লোডভিক ডি ক্রুইফ। সিনসিয়ারিটির অভাব, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের প্রবণতা, চুক্তির বাইরে চলে যাওয়া, মিডিয়ার কাছে অনবরত নেগেটিভ কথা বলা, ৪৮০ দিনের মধ্যে ২২৪ দিনই নানা অজুহাতে নিজ দেশ হল্যান্ডে গিয়ে ছুটি কাটানো ... ইত্যাদি অভিযোগ তুলে ২০১৪ সালের অক্টোবরে বাফুফে ক্রুইফকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপারÑ ক্রুইফকে এরপর আরও দুই দফায় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয় বাফুফে। ক্রুইফ সম্পর্কে বলা হয়, ছুটিতে থাকাকালীন হল্যান্ডে বসে ই-মেইল এবং ফেসবুকে কোচিং করাতেন তিনি। কে জানে, জেমিও নিশ্চয়ই সেই একই পথে হাঁটছেন। থাকা-খাওয়া, বাসস্থান, সন্তানদের স্কুল, চিকিৎসা ফ্ল্যাট, গাড়ি, বোনাস, স্বাস্থ্যবীমা, বিজ্ঞাপন বাবদ টাকা, জাতীয় দলের প্রতিপক্ষের খেলা দেখতে যেতে আগাম টিকেট, পরিবারের জন্য বাড়তি বিমান টিকেট, বাবুর্চি ... সাধারণত এসব বিষয়গুলোই কোচের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয় বাফুফে।
×