ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ভূমিহীন মানুষ এবং ভূমি সংস্কার

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯

ভূমিহীন মানুষ এবং ভূমি সংস্কার

মুঘল আমলে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের গভীর বন কেটে আবাদি জমি এবং বসতির পত্তন হয়েছিল। বন কাটার জন্য ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল স্থানীয় এক ধরনের উদ্যোক্তাদের। তারা লোক জোগাড় করে বন কেটে জমি পুনরুদ্ধার করত। একালে ওই প্রক্রিয়ায় চলছে চর দখল। বন বিভাগের আওতায় প্রথমে চরের জমিতে গাছ লাগানো হয় বালিমাটি মজবুত করার জন্য। পরে এগুলো কেটে বসবাস ও আবাদি জমির উপযোগী করলে বিশাল চরাঞ্চলের দিকে দৃষ্টি পরে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও ক্ষমতাধরদের। ছলেছুতোয় উৎখাত হতে থাকে চরাঞ্চলের গরিব মানুষেরা। কৃষিতে উৎপাদনশীল ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমি সংস্কার বিশেষ করে পুনর্বণ্টনকামী ভূমি সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এতে বড় ভূমি মালিকদের কাছ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত সীমা বা সিলিংয়ের পর যে উদ্বৃত্ত থাকে রাষ্ট্র তা অধিগ্রহণ করে ভূমিহীন এবং গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে। এতে উৎপাদনের পরিমাণ এবং উৎপাদনশীল পুঁজির সঞ্চালন বাড়ে। জাপান ও তাইওয়ানে এটা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও আজ পর্যন্ত এ সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়নি। মূলত ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মহলের দখল ও আধিপত্যের কারণে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই দখল আধিপত্য চলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দায়ী করা হয় এবং শুধু এদিকেই দৃষ্টি থাকায় খাস জমি, ভূমি সংস্কার, পুনর্বণ্টন ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখের আড়ালেই রয়ে যায়। কৃষি জমি কমে যাওয়া এবং কৃষির ধনতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে ভূমি সংস্কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। শুধু তাই নয়, ভূমিহীন কৃষক বা ক্ষেত মজুরের সংখ্যা দ্রুত বাড়ার পেছনেও এর ভূমিকা অপরিসীম। উনিশ শ’ একাত্তর সালে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ছিল শতকরা তেইশ ভাগ। পঁয়তাল্লিশ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা আটাত্তর ভাগ। কৃষিকে যে জাতির অর্থনীতির মেরুদ- বলা হয় তার কৃষকের এ চিত্র নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, প্রতিবছর দেশে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে আটষট্টি হাজার সাত শ’ হেক্টর। অর্থাৎ গড়ে শতকরা এক ভাগ হারে। মূল কারণ হিসাবে ওই জনসংখ্যার দিকেই ইঙ্গিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতানুগতিক আলোচনা থেকে চোখ ফিরিয়ে একটু অন্যদিকে মনোযোগ দেয়া যাক। পাকিস্তান আমলে উনিশ শ’ পঞ্চাশ সালে জমিদারি প্রথা এবং মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের ভূমিকা বিলুপ্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণয়ন হয়। এতে বলা হয়Ñ কোন পরিবারের এক শ’ বিঘার বেশি আবাদি জমি এবং বসতভিটার জন্য দশ বিঘার বেশি থাকলে তা ‘উদ্বৃত্ত’ হিসেবে গণ্য হবে এবং ওই উদ্বৃত্ত অংশ রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করবে। এভাবে অধিগ্রহণ করা জমি রাষ্ট্র বণ্টন করবে প্রকৃত কৃষকের মধ্যে, যারা পরিবারপ্রতি তিন একরের কম জমির মালিক। শুনতে দারুণ লাগলেও বাস্তবে বড় জমির মালিকরা উদ্বৃত্ত জমি রাষ্ট্রকে না দিয়ে নিজেদের পরিবারের সদস্য ও অনুগতদের কাছে নামে-বেনামে হস্তান্তর করে। আইনের দুর্বলতার সুযোগেই এটা তারা করত। এতে পুনর্বণ্টনের জন্য রাষ্ট্রের হাতে জমি থাকত খুব কম। পরে উনিশ শ’ একষট্টি সালে সামরিক শাসকের আমলে আবাদি জমির সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং এক শ’ বিঘা থেকে বাড়িয়ে তিন শ’ পঁচাত্তর বিঘা করা হয়। এতে বড় জমির মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হলেও পুনর্বণ্টন করা জমির পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় পরিবারপ্রতি এক বিঘা বা তারও কম। এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পুনর্বণ্টিত জমির তালিকায় ভূমিহীন কৃষকদের জায়গা ছিল না। স্বাধীনতার পর উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে সর্বোচ্চ আবাদি জমির পরিমাণ পরিবারপ্রতি আবারও এক শ’ বিঘায় নামিয়ে উদ্বৃত্ত জমি রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে বলা হয়। পুনর্বণ্টনের তালিকায় এবার অগ্রাধিকার দেয়া হয় ভূমিহীন ও গরিব কৃষি পরিবার এবং নদীভাঙনে ছিন্নমূল মানুষদের। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিভিন্ন শর্ত শিথিল হওয়ায় রাষ্ট্রের হাতে জমা পড়া উদ্বৃত্ত জমির পরিমাণ শতকরা পাঁচ ভাগেরও কমে এসে দাঁড়ায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভূমিহীন কৃষক ও ছিন্নমূলের অগ্রাধিকার তালিকাতেই ছিল, বাস্তবে তাদের ভাগ্যে তেমন কিছুই জোটেনি। পুনর্বণ্টন হয়েছে মূলত বিভিন্ন সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে। এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় উনিশ শ’ আশি ও নব্বই দশকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান নাক গলিয়ে বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের গতিমুখ আমূল পাল্টে দেয়। বলা ভাল, রাষ্ট্রীয়ভাবে ভূমি সংস্কারের চেষ্টার আপাত মৃত্যু ঘটে। তাদের মতে, বাংলাদেশে পুনর্বণ্টনমুখী ভূমি সংস্কার এখন সম্ভব নয়, কারণ জনসংখ্যা বেড়ে গেছে কিন্তু জমির পরিমাণ বাড়েনি। জনসংখ্যা বাড়ার ধুয়া তোলার সেই শুরু। জনসংখ্যা বাড়ছে এ নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে একে মুখ্য ইস্যু করা হয়েছে। পুনর্বণ্টনমুখী ভূমি সংস্কারের বিরোধিতায় বিশ্বব্যাংকের যুক্তি ছিল রাষ্ট্র যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত আদায় করতে পারবে সে তুলনায় ভূমিহীনদের সংখ্যা অনেক বেশি। তা দিয়ে প্রতিটি পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো যাবে না। এর চেয়ে কম জমি দিলে তারা বিক্রি করবে নয়ত খাজনায় অন্যকে চাষ করতে দেবে। তাতে জমি পুনর্বণ্টনের মূল লক্ষ্য ব্যর্থ হবে। স্পষ্টতই ক্ষমতাবান এবং সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর জমি আত্মসাতের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে তারা। বিশ্বব্যাংক, যেসব যুক্তিতে ভূমি সংস্কারের বিপক্ষে সুপারিশ করেছে তার উদ্দেশ্য যে ছিল আসলে ভূমিহীনদের চিরস্থায়ী ভূমিহীন করে রাখা আর শাসক শ্রেণী ও তাদের কৃপাধন্যদের জন্য দুর্নীতির দ্বার অবারিত করা। তাদের যুক্তিগুলো দেখলেই তা বোঝা যায়। যুক্তিগুলো ছিল এ রকম, এক. উদ্বৃত্ত জমি সংগ্রহ করতে গেলে বড় জমির মালিকদের সঙ্গে রাষ্ট্র ও অন্যান্য শ্রেণীর বিরোধ ঘটবে- তাই এ ধরনের সামাজিক সংঘাত এড়িয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। দুই. কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লব’ বলে পরিচিত নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে ছোট-বড় নির্বিশেষে সব কৃষকের উৎপাদন বেড়ে যাবে। এতে অল্প জমিতেও বেশি ফলনের কারণে ছোট কৃষক তার জীবিকার চাহিদা মেটাতে পারবে। তাতে করে তার আর অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন হবে না। তা ছাড়া এ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে সার্বিক ফলন বাড়বে তাতে ভূমিহীন কৃষকরা দিনমজুর হিসেবে আগের চেয়ে বেশি কাজ পাবে। সুতরাং ভূমি সংস্কারের মতো জটিল ও সংঘাতময় পথে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তিন. লিজ বা বর্গার মধ্য দিয়ে বড় জমির মালিকের কাছ থেকে ছোট মালিক যদি প্রয়োজনমতো জমি ভাড়া নিতে পারে, তাহলে মালিকানা পুনর্বণ্টনের প্রয়োজন পড়ে না। তার চেয়ে বরং মালিকানার খতিয়ান এবং দলিলপত্র হালনাগাদ করতে সঠিকভাবে জমি জরিপ করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা আরও জরুরী। এতে জমি ভাড়া করার বাজার গতিশীল হবে এবং তাতেই পুনর্বণ্টনের চেয়ে ভাল অর্জন হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে যা করা হয়েছে তা ভূমি সংস্কার নয়, বাজারভিত্তিক ভূমি ব্যবস্থাপনা, এর সপক্ষে তখন ভাড়াটে বিশেষজ্ঞরা শতমুখে প্রচার চালাতে থাকেন। বিদেশী দাতা সংস্থার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট আসে দেশীয় কনসালট্যান্ট ও বিশেষজ্ঞদের কাছে। সংস্কারের বিকল্পে কম্পিউটার এবং তথ্যপ্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ায় এসব বিশেষজ্ঞের তৎপরতা ও প্রচারের ঝলকানিতে চমক লাগলেও সত্যিকারের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।
×