ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

কালজয়ী ক’টি বাংলা গানের নেপথ্য কাহিনী

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ৪ অক্টোবর ২০১৯

কালজয়ী ক’টি বাংলা গানের নেপথ্য কাহিনী

সাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে গান। প্রার্থনা-বন্দনা, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, প্রকৃতি-কল্পনা, আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে গানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। গান আমাদের মনের খোরাক, যা আমাদের মনের তৃষ্ণা মেটাতে পারে। তাই আমরা মনের তৃষ্ণা মেটাতে গান শুনে থাকি এবং গান গাই। সবার মাঝেই একটি গায়কী সত্তা বিদ্যমান রয়েছে। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি গান পছন্দ করেন না। মানুষ তার আবেগ ও অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কখনো গলা ছেড়ে আবার কখনো গুনগুনিয়ে গান গেয়ে থাকে। প্রতিদিন গান শোনা কিছু মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। যখন ইচ্ছে, অলস দুপুরে, পড়ন্ত বিকেলে, রাতের তিন প্রহরে গান শোনা চাই। ভ্রমণে বের হলে গাড়িতে বসে, কোন কাজের মাঝেও গান শোনা চাই। কখনো কখনো গানের মাঝেই প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাই। আমাদের মনের খোরাক পূরণ করে কিছু কিছু গান এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, যা যুগের পর যুগ মানুষের মুখে মুখে সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখে। এমন গানকে বলা হয়ে থাকে কালজয়ী গান। প্রতিটি গান রচনার নেপথ্যে কোন না কোন প্রেক্ষাপট থাকে। যা আমাদের কাছে অজানা-ই থেকে যায়। সেই অজানা ঘটনাগুলো জানার কৌতূহল সংগীত প্রেমী সবার মনেই আছে। আজ কলম ধরেছি কিছু কালজয়ী বাংলা গানের নেপথ্য কাহিনী লিখতে। কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু সুনামগঞ্জের উজান ধলের ভাটি বাংলার বাউল কবি শাহ আব্দুল করিমের বেশ কিছু কালজয়ী গানের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’। অনেকেই এই গানটি একটা আধ্যাত্মিক বা দেহতত্ত্বের গান হিসেবে ধারণা করে। তবে এই ধারণাটা সম্পূর্ণরূপে ভুল। শাহ আব্দুল করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী আফতাবুন নেসা, যাকে তিনি ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন ‘সরলা’। করিমের দারিদ্র্যের সংসারের ঘানি টানতে টানতে সরলা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। করিমের সংসারে যেখানে পান আনতে পান্তা ফুরায়, সেখানে চিকিত্সার খরচ বহন করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই করিমের চোখের সামনেই অনেকটাই বিনা চিকিত্সায় রোগের যন্ত্রণা নিয়ে সরলা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে। করিম বিভিন্ন জায়গায় গানের বায়না করেও চিকিত্সার খরচ জোগাতে পারেনি। একবার এক গ্রামে গান গাওয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়ে করিম গান গাইছেন, এমন সময় সরলার মৃত্যুর খবর আসে। করিম বাড়িতে ফিরলে তার গৃহের পাশেই সরলার কবর দেয়া হয়। করিম সরলাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই নিজেকে দায়ী করতেন। ঠিকমতো চিকিত্সা করাতে পারলে হয়তো সরলার এভাবে কষ্ট পেয়ে মৃত্যু হতো না। করিমের বাড়ির পাশেই বয়ে যাচ্ছে কালনী নদী। এই নদীর তীরে বসে সরলার মৃত্যুর শোকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে করিম গাইতে থাকেন- ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবা যদি/ কেমনে রাখিবো তোর মন/ আমার আপন ঘরে বাধিরে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবা যদি/ পাড়া পড়শী বাদী আমার/ বাদী কালনী নদী/ মরম জ্বালা সইতে নারি/ দিবা নিশি কাঁদিরে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবা যদি’। শুয়া চান পাখি বাংলা ফোক গানের কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী প্রয়াত বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা অর্জন করা কালজয়ী একটি গান হচ্ছে ‘শুয়া চান পাখি’। শুয়া মানে শুয়ে থাকা, চান মানে চাঁদ আর পাখির মানেটা সবারই জানা। বারী সিদ্দিকী ছিলেন নেত্রকোনার প্রখ্যাত বাউল সাধক উকিল মুন্সীর একজন শিষ্য। এই গানটির মূল রচয়িতা হচ্ছেন উকিল মুন্সী। গানটি রচনার নেপথ্যে রয়েছে একটি করুণ কাহিনী। একবার উকিল মুন্সী বেশ দূরের একটা গ্রামে গান গাইতে বায়না নিয়েছিলেন। গান গাইতে দলবল নিয়ে যেদিন বাড়ি থেকে বের হবেন, তখন গৃহে তার স্ত্রী ছিলেন অসুস্থ। যেহেতু বায়না রাখা হয়ে গেছে, তাই তিনি না গিয়ে কোন উপায় নেই। তিনি সেই গ্রামে গান গাইছেন আর এমন সময় খবর এলো তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল না, তাই পায়ে হেঁটে পথ চলতে হতো। বাড়ি ফিরতে তাই উকিল মুন্সীর তিন দিন সময় চলে যায়। এসে দেখে স্ত্রীকে বাড়ির পাশেই কবর দেয়া হয়েছে। তিনি স্ত্রীর কবরের পাশে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আর তখন তিনি বিলাপ করে গেয়ে উঠলেন- ‘শুয়া চান পাখি আমার/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি/ তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/ আইজ কেন হইলে নীরব/ মেল দুটি আঁখি রে পাখি’। বাংলাদেশ ও আলাল-দুলাল বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের পপসম্রাট, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের দুটি কালজয়ী গান হচ্ছে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘আলাল-দুলাল’। আজম খান নিজেই এ গান দুটির গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। আলাল-দুলাল গানটি মূলত আজম খানের বন্ধুদের সম্মিলিত প্রয়াস। এই গানটি ঘিরে আছে একটি মজার ঘটনা। কবি জসীম উদদীনের বাড়ির বাগানের দেবদারু গাছতলায় প্রতিদিনই তারা সব বন্ধুরা আড্ডা দিতেন। গিটার নিয়ে টুংটাং করতেন। তার দুই বন্ধু শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর আপন দুই ভাই। তারা তাদের বাবার খুব আদরের সন্তান ছিল। তাই তাদের ‘আলাল-দুলাল’ বলে ক্ষেপাতো আজম খানের আরেক বন্ধু আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। তাদের ক্ষেপাতেই ‘আলাল-দুলাল’ গানের সৃষ্টি। পপসম্রাট এ গান গাইলে লজ্জায় শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকতেন। প্রথম প্রথম গাইতেন, ‘আলাল-দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি’। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। তাদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। তার মেজভাই সঙ্গীত পরিচালক আলম খান গানটি শুনে বললেন, ‘পুলের জায়গায় চানখাঁর পুল শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে।’ তাই করলেন তিনি। একদিন ভাবলেন, গান যখন গাইছেন এটা নয় কেন? বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। তারপর গানটি রাতারাতি হিট। বাংলাদেশ গানটি তখন দেশের এক করুণ পরিস্থিতি দেখে তিনি রচনা করেছিলেন। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। তখন দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে। দরিদ্র মানুষের পেটে ভাত নেই, ক্ষুধার রাজ্যে সাধারণ মানুষের হাহাকার। তখন কমলাপুর থেকে নটর ডেম কলেজের ফুটপাথ মানুষে ভরপুর। এখানে ওখানে অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। মা তার দুধের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুধার জ্বালায় কেউ কেউ নিজের বাচ্চাকে বিক্রিও করে দিচ্ছেন। তখন নতুন নতুন গান করতেন আজম খান। রেললাইনের পাশের ফুটপাথের বাচ্চাগুলো তাকে দেখলে মামা মামা বলে ডাকত। তিনি প্রায়সময়ই সেখানে যেতেন এবং বিভিন্ন করুণ দৃশ্যের মুখোমুখি হতেন। তাদের সাথে গল্পে-আড্ডায় বস্তির মানুষের হাহাকারের কথা শুনে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেত। তখন তিনি ওই সময়ের হৃদয় বিদারক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে লিখে ফেললেন তার কালজয়ী গান ‘বাংলাদেশ’। এই গানটি নিয়ে ১৯৭৫ সালে ভীষণ একটা হৈচৈ পড়ে যায়, আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান আজম খান। তার গানের ভাষার সাথে একাত্ম হয় সাধারণ মানুষ। আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়- ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তার কাঁদে/ ছেলেটি মরে গেছে/ হায়রে হায় বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
×