ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পোল্ট্রি খাতে তাপদাহের প্রভাব

ডিম ও মাংসের উৎপাদন কমেছে বাজারে সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কা

কাজী জাহিন হাসান

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ৮ মে ২০২৪; আপডেট: ১৫:৪৫, ৯ মে ২০২৪

ডিম ও মাংসের উৎপাদন কমেছে বাজারে সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কা

ডিম ও মাংসের উৎপাদন কমেছে

অসহনীয় তাপদাহ দেশের পোল্ট্রি খাতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে। মাত্রাতিরিক্ত তাপে খামারে মুরগির মৃত্যুহার বেড়েছে। ঘাটতি পড়েছে মুরগির ওজনে। ডিমের উৎপাদন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এসব কারণে বড় ধরনের লোকসান এড়াতে অনেক উদ্যোক্তা খামার পরিচালনা থেকে সরে এসেছেন। ফলে মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের খামারিসহ খাতসংশ্লিষ্টরা।

প্রান্তিক খামারি ও বড় উদ্যোক্তাদের মতে, এ বছরে গ্রীষ্মের শুরু থেকে অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রার কারণে পোল্ট্রি খামারে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মুরগি মরে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে মুরগি খাবার খেতে পারছে না। এতে মুরগির স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার গতি কমে যাচ্ছে, এবং তাতে মুরগি প্রতি গড়ে ৫শ’ গ্রাম ওজন কমছে। ফলে উৎপাদনে টান পড়ছে। একই কারণে লেয়ার মুরগির খামারে ডিমের উৎপাদন কমেছে গড়ে ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি ডিমের আকারও ছোট হচ্ছে। খোসা পাতলা হওয়ার কারণে ডিম বাজারজাত করা দুরূহ হচ্ছে। সব মিলে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
গত ২৬ এপ্রিল রাজধানীর পার্শ¦বর্তী পোল্ট্রি শিল্পঘন জেলা গাজীপুরের বিভিন্ন পর্যায়ের খামার সরজমিনে পরিদর্শনকালে খামারিরা জানিয়েছেন, তীব্র গরম আবহাওয়ার প্রভাবে মুরগির খামারে হঠাৎ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। বিশেষ করে হিট স্ট্রোক, কিডনি বিকল ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে সব খামারেই প্রতিদিন কম-বেশি মুরগি মারা যাচ্ছে। সেই সাথে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি আকারে।

আলাপচারিতায় এসব তথ্য চিত্র তুলে ধরে বেশি খরচ করেও উৎপাদন বিপর্যয়ে নিপতিত পোল্ট্রি খামারিরা সীমাহীন লোকসানের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, কেবল গাজীপুরের নয়, সারা দেশের পোল্ট্রি শিল্পের একই দশা।
খামারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে গাজীপুর সদরের আঙ্গুটিয়া চালা গ্রামের গত দেড় দশকের অভিজ্ঞ ব্রয়লার খামারি মমতাজ বেগম (৩৫) জানান, গরম আবহাওয়ার কারণে মুরগি ঠিকমত খেতে পারছে না, খাবার হজম হচ্ছে না, ফলে মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে না এবং ওজনও বাড়ছে না।
তিনি জানান, কৃষক স্বামীর সহায়তায় পরিচালিত তাদের ‘সুমাইয়া পোল্ট্রি ফার্ম’ এ সাড়ে তিন হাজার মুরগি পালন উপযুক্ত শেড থাকলেও অতি গরমের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বর্তমানে দুই হাজার ব্রয়লার মুরগি পালন করছেন।
তারপরও ইতিমধ্যে অর্ধ শতাধিক মুরগি হিট স্ট্রোকে মরে গেছে। খামারে একই বয়সী বিভিন্ন আকারের মুরগি দেখিয়ে উদ্বিগ্ন মমতাজ বলেন, যে পরিস্থিতি তাতে এ দফায় ৩২ দিনের মেয়াদের পরিবর্তে ৩৬ দিনেও প্রত্যাশিত ওজন পাওয়া যাবে না। তার মতে, শীতকালে প্রতি মুরগির ওজন গড়ে দুই কেজি হলেও এবারের গরমে অতিরিক্ত ওষুধ খরচ ও বেশি বিদ্যুৎ বিলের পাশাপাশি বেশি সময় ধরে লালন পালন করেও দেড় কেজির বেশি ওজন পাওয়া যাবে না।
জেলার সিটি করপোরেশনভুক্ত নান্দুয়াইন এলাকায় তিন দশক ধরে রেডিক্স পোল্ট্রি অ্যান্ড ডেইরী ফার্ম চালান উদ্যোক্তা সৈয়দ আব্দুল মুনায়েম। আট হাজার মুরগি পালন উপযোগী ৪টি শেডের মধ্যে অতি গরমে উৎপাদন বিপর্যয়ের ঝুঁকি মুক্ত থাকতে চলতি এপ্রিল মাসে ২টি শেডে চার হাজার ব্রয়লার পালন বন্ধ রেখেছেন। তবে হরেক সতর্কতা অবলম্বন করে ডিম উৎপাদনে প্রায় তিন হাজার লেয়ার মুরগি পালন অব্যাহত রেখেছেন গত ৩৫ সপ্তাহব্যাপী।

বয়সের হিসেবে প্রায় ষাটের কোটা ছুঁতে চলা এই অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা সৈয়দ মুনায়েম জানান, “চলতি তাপপ্রবাহের আগে আমাদের ডিমের উৎপাদন ৯৩ শতাংশ, যা বর্তমানে ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে।”
দীর্ঘ অভিজ্ঞ এই উদ্যোক্তার মতে, অতি গরমে মুরগি খাবার কম খাওয়ার কারণে খামারির খরচ বাঁচে না, বরং ব্রয়লার মুরগির মত লেয়ার মুরগিরও বৃদ্ধি এবং ওজন কমে যায়, শক্তি সামর্থ্য হারায়। ফলে ডিমের উৎপাদনে ভাটা পড়ে। পক্ষান্তরে ওষুধসহ বাড়তি পরিচালনা ব্যয়ের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
জেলা সদরের শালনা মোল্লা পাড়ার তরুণ খামারি মোঃ আবু নাঈম। স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস শেষে পৈত্রিক ভিটায় ১৪শ’ মুরগির খামার গড়েছেন । তিনি জানান, “চলমান ব্যাচে ব্রয়লার মুরগি তুলেছিলাম এক হাজার। চার সপ্তাহের ব্যবধানে হিট স্ট্রোকে মরেছে অর্ধ শতাধিক মুরগি। স্যালাইন ও ওষুধে বাড়তি খরচ করেও গরমের তীব্রতায় বয়স অনুযায়ী মুরগির ওজন বাড়ছে না। এ ব্যাচের মেয়াদ শেষে মোট মুরগির ওজন ৩শ’ কেজি কম হবে” বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন এই খামারি।

পার্শ্ববর্তী বাউপাড়ার পঞ্চাশোর্ধ প্রান্তিক খামারি বিজয় চন্দ্র বর্মণও তার খামারে গতানুগতিক ২৪শ’ থেকে দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে এ ব্যাচে মাত্র ৮শ’ মুরগি তুলেছিলেন। তার মধ্যেও ৫০টি ইতিমধ্যে মরেছে এবং প্রতি দিন ১/২টি মুরগি মরছে উল্লেখ করে বলেন, “মেয়াদ শেষে যা থাকবে তারও ওজন আগের তুলনায় সাড়ে ৪ থেকে ৫শ’ গ্রাম কম হবে। এতে মুরগি বেঁচে খরচ উঠবে না, বরং লোকসান গুনতে হবে।”

বাউপাড়ার লেয়ার খামারি ইউনূস আলী (৫৫) জানান, প্রতিটি লেয়ার মুরগি স¦াভাবিকভাবে দিনে সোয়াশ’ গ্রাম খাবার খায়, কিন্তু এবারের অতি গরমের কারণে তা ৮৫ গ্রামে নেমেছে। এতে করে তার খামারে ডিমের উৎপাদন ৯৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৮০ শতাংশে। যা তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে বলেও প্রকাশ করেন তিনি।
জেলা সদর জয়দেবপুরের ভাওরাইত পোড়াবাড়ীর মামুন পোল্ট্রির তত্ত্বাবধায়ক নূরু ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, চলতি মৌসুমে রেকর্ড ভাঙ্গা গরম আর সীমা ছাড়া বিদ্যুৎ বিভ্রাট মুরগির খামারে ঝুঁকি বাড়িয়েছে এবং তা এ খাতের ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত ঝুঁকিতে ফেলেছে।
গাজীপুর জেলার পোল্ট্রি উদ্যোক্তাদের কাছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন পোল্ট্রি চিকিৎসক সাজেদুল ইসলাম। এ এলাকার বিভিন্ন খামার পরিদর্শনকালে এ শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, মুরগির সুস্থ স্বাভাবিক বৃদ্ধির উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ২৪ থেকে ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে উঠলেই এ শিল্পে নানান রকম ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তার হিসেবে দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ খামারে আধুনিক তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, সে কারণে বর্তমান তাপদাহে পোল্ট্রি শিল্প কঠিন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

দেশে পোল্ট্রি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের অন্যতম সংগঠন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, অসহনীয় তাপদাহ আর তীব্র বিদ্যুৎ সঙ্কটে পোল্ট্রি খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে তাপনিয়ন্ত্রণ সুবিধা থাকা বড় খামারগুলোও বাড়তি ব্যয়ে জেনারেটর চালিয়ে সামাল দিতে পারছে না। একই সাথে প্রান্তিক খামারিদের খামারগুলোতে বৈদ্যুতিক পাখাও চালাতে পারছে না। এতে পোল্ট্রি খামারের ২৫ শতাংশ মুরগি ও ২৫ শতাংশ ডিমের উৎপাদন কমে গেছে।
বর্তমানেও বাজার চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে ৫ কোটি পিস ডিম এবং ২৫ লাখ পিস মুরগি সরবরাহ হচ্ছে উল্লেখ করে এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতা মাহবুবুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, খামারগুলোতে বর্তমানে ডিম ও মুরগি চাষে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন অন্তত এক কোটি ২৫ লাখ পিস ডিম এবং ৬ লাখ ২৫ হাজার পিস মুরগির সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিতে পারে। 

কাজী জাহিন হাসান : ঢাকায় বসবাসকারী একজন ব্যবসায়ী এবং কাজী ফার্মসের পরিচালক।

×