ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : ফৌজি বুখরিস;###;অনুবাদ : ফজল হাসান

মরক্কোর গল্প ॥ দুঃস্বপ্ন

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ৩০ আগস্ট ২০১৯

মরক্কোর গল্প ॥ দুঃস্বপ্ন

মরক্কোর সমকালীন কথাসাহিত্যের অন্যতম লেখক ফৌজি বুখরিস। তাঁর জন্ম সাফি শহরে, ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই। তিনি আরবী ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ‘জুম’ তাঁর ছোট গল্পসংকলন। গল্পসূত্র : ‘দুঃস্বপ্ন’ গল্পটি ফৌজি বুখরিসের ইংরেজীতে ‘নাইটমেয়্যার’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি আরবী থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন মোহাম্মেদ সাইদ রাইহানি। গল্পটি মরক্কোর ছোটগল্প সংকলন ‘দ্য মরোক্কান ড্রিম: অ্যান এ্যান্থোলজি অব মরক্কান নিউ শর্ট স্টোরিজ’-এ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে (২৯ ডিসেম্বর ২০০৬) অনুবাদকের ওয়েবসাইট ‘রাইহানি’তে সংযোজিত হয় এবং সেখান থেকে নেয়া হয়েছে। ‘স্বপ্ন একটি শান-বাঁধানো সড়ক, যা আমাদের নিজেদের দিকে এবং মুক্ত এলাকার দিকে প্রসারিত যেখানে নিদর্শন ও বিষয়বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন স্বপ্ন আমাদের অন্তর্জগত, যার বিস্তৃতি আবিষ্কার করার জন্য সবসময়ই আমাদের পথনির্দেশিত থাকা উচিত।’ হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা এগিয়ে আসে এবং ঘরটি অন্ধকারে ডুবে যায়। রাস্তার দিকে মুখ করা জানালার বাইরের কাঁচের ওপর আলোকিত পান্ডুর দাগ দেখা যায়। অন্ধকার উপভোগ করার জন্য তুমি নিজেকে সমর্পিত করেছ। তোমার কাছে মনে হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ক্রমশ ভারি হচ্ছে যেন তুমি গভীর অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছো। তুমি অনুভব করতে শুরু করেছ অলসতা তোমাকে এমন ভাবে অদৃশ্য বাঁধনে জড়িয়ে ধরেছে যে, তুমি কিছুতেই উঠতে পারছো না। জানালার কাছে যাওয়ার আগে তুমি পায়ের ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ানোর জন্য কিছুটা সময় নিলে। তারপর ভাঙা জানালার ছিদ্র গলিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে রাস্তার দিকে উঁকি দিলে। তুমি তোমার সুরক্ষিত মিনারের ছেঁড়া পর্দায় ক্ষুদ্র ফুটো করে নিজেকে সবার দৃষ্টি এবং সব জায়গায় সব কিছু আড়াল করে রেখেছ। তোমার এই গোপনীয়তাকে তুমি দারুণ উপভোগ করো : তুমি সবাইকে দেখ, কিন্তু কেউ তোমাকে দেখতে পায় না। মেয়েটি রাস্তার উল্টো দিকের ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে ‘রক এ্যান্ড রোল’ সঙ্গীতের তালে তালে নাচছে। তুমি আশা করছো যে মেয়েটি তোমার নীরব আহ্বানে সাড়া দিবে এবং ভালবাসার মোহনীয় দৃষ্টি মেলে তোমার দিকে তাকাবে। রাস্তার শেষ মাথায় অন্ধকারের মাঝে একজনের ব্যক্তিগত জায়গায় কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত ছায়ার মতো দুটি নকশা আঁকা বাড়ি আছে। কিছু ছেলেমেয়ে বৈদ্যুতিক পোস্টের চারপাশ ঘিরে তাস খেলছে ... তোমার কানে মাইক্রোফোনের তীক্ষè আওয়াজ এসে পৌঁছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই মোয়াজ্জিনের আজানের সুর ভেসে আসে। কয়েক মুহূর্ত পরে আশপাশের দোকানের দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা যায়। দোকানিরা কখনই সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করার সুযোগ হারায় না। যত ধরনের বন্ধন তোমাকে দুনিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে, তা থেকে তুমি নিজেকে মুক্ত করতে চাইছো এবং পার্থিব জীবনের গতানুগতিক গুরুত্বহীন ঘটনা থেকে নিজেকে আড়াল করে কোন বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে চাইছো। ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে তুমি সিগারেটে অগ্নিসযোগ করলে। তারপর মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে পুরো ঘরে ছড়িয়ে দিলে। অন্য জায়গায় ধূমপান করার সময় তোমার মধ্যে যে ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং মনে হয় শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, ঠিক একই ধরনের অনুভূতি তুমি উপলব্ধি করছো তোমার দু’ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটে। কল্পনায় দেখার জন্য তুমি সবগুলো ছবি পুনরায় মেলে ধরলে। তুমি সেই ছবিগুলো আরও সুন্দর করে দেখতে পারবে, যখন তুমি ওগুলোর হেঁয়ালী পাঠোদ্ধার করবে এবং উন্মোচন করবে যে ছবিগুলো আড়ালে কামদ ভাবের প্রবণতা আছে। যাহোক, গ্যালারীর মালকিন ইতালিয়ান অপ্সরী লরার চোখ সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় মনে হবে। তখন তুমি আপনমনে নিজেকে বলবে: ‘সৌন্দর্যই সুন্দরের আকুল আকাক্সক্ষা অনুভব করে।’ তোমার মনে পড়বে আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে এক জায়গায় লিখেছেন যে, ইতালিতে চোখের সৌন্দর্য পরিচয়সূচক এক ধরনের নিবন্ধিত সঙ্কেতচিহ্ন। এখন তুমি তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্রমশ ভারি অনুভব করতে শুরু করেছ। অপ্রত্যাশিত কারণে যখন ঘুম পাতলা হতে বাধা দেওয়ার শক্তি তোমার মধ্যে দুর্বল হতে থাকে, তখন তোমার কণ্ঠস্বরের স্পর্শকাতরতা তীক্ষè এবং ধারালো হয়। তোমার এবং ঘুমের রাজ্যের মধ্যে পরিত্যক্ত মাকড়শার জালের মতো নড়বড়ে সুতোয় বাঁধা, তা কিঞ্চিৎ আওয়াজের প্রবাহে ছিঁড়ে যাবে। মাতালের মতো তুমি খেলা শুরু করবে এবং দূরের কণ্ঠস্বর শুনতে থাকবে। রাত্তিরের নিস্তব্ধতা দূরের শব্দকে অতি নিকটে নিয়ে আসে। তখন তুমি দূরে কোথাও পার্কিংয়ে গাড়ি থামানোর আওয়াজ ছাড়া কোনকিছুই আলাদা করতে পারবে না। এমনকি তুমি নিজের চোখেও দেখতে পারবে: ভয়ার্ত কোন জন্তুর মতো গাড়ি থরথর করে কাঁপছে। সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পরপরই তুমি নিজেকে দুঃখিত মনে করবে। তুমি কখনই এমন কোন সময় ঘুমাতে পারবে না যখন তুমি দুঃখে থাকবে না। তোমার চোখের পাতায় এসে দুঃখ জমা হবে। জানালা গলিয়ে ঘরের মধ্যে রাত নামবে: অন্ধকার এসে সরব হবে, তারার মালায় আকাশ অলংকৃত হবে, দূরের শব্দ থাকবে, কিন্তু কোথাও চাঁদের হদিশ থাকবে না। অকস্মাৎ তুমি বুকের মধ্যে অদৃশ্য ভারি পাথরের উপস্থিতি টের পাবে এবং তোমাকে নিস্তেজ করে দিবে। তুমি নড়াচড়া করতে পারবে না। তোমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। তখন তুমি শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে এবং বুকের জগদ্দল পাথর সরাতে চাইবে। কিন্তু তোমার সব চেষ্টাই বৃথা যাবে... তুমি অসহায়ত্তের কাছে বন্দী হবে। অনেক কষ্ট করে তুমি শ্বাস নিবে এবং তোমার কাছে মনে হবে যেন তুমি বুকের ভেতর অক্সিজেনের শেষ অণুটি টেনে নিচ্ছ ... তোমার বিশাল দেহের মধ্যে তুমি আঙুল ঢুকিয়ে বুকের ভেতর থেকে পাথরটি উপড়ে ফেলে দিতে চাও। তুমি রুদ্ধ কণ্ঠে সাহায্য চাইছো। তুমি কাঁপতে শুরু করেছ, কিন্তু বুঝতে পেরেছ যে তোমার কণ্ঠস্বর অসীমের মাঝে হারিয়ে গেছে। কোথাও কোন প্রতিধ্বনি নেই। তুমি চিৎকার- চেঁচামেঁচি করছো, কিন্তু কেউ শুনতে পারছে না। ভয়ে-আতঙ্কে তুমি জেগে উঠেছো এবং কপালের ঘর্মাক্ত শীতল ফোঁটা তুষারগোলকের মতো তোমার মুখম-ল বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। তুমি ক্লান্ত। তোমাকে দেখে মনে হবে যেন তুমি কোনো ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঠে এসেছ। তোমার চোখেমুখে বিস্ময়: ‘এটা কী দুঃস্বপ্ন?’ একসময় জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরের মধ্যে লুটিয়ে পড়েছে এবং আশপাশের কোনো শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায় না। বিশ্বভ্রহ্মান্ড জুড়ে নিস্তবদ্ধতা বিরাজ করছে। অন্যান্য শব্দ থেকে নিস্তব্ধতার শব্দের উপস্থিতি অনায়াসে আলাদা করা যায়। নিস্তব্ধতার মাঝে মৃদু আওয়াজের ফিসফিসানি কানে ভেসে আসে এবং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও জোরে বাজতে থাকে। তুমি দু’হাত এক সঙ্গে করেছো। তারপর তোমার গোপন অঙ্গের কাছে দু’ঊরুর মাঝে জোড়া হাত চেপে ধরেছ। তুমি শরীরটাকে নাড়িয়ে ভ্রƒণের মতো গোল হয়ে শুলে, যেমন ভাবে প্রচ- ঠা-ায়, কিংবা ভয় পেলে, এমনকি একাকীত্বের সময় কুঁকড়ে শোও। অবশেষে একসময় উষ্ণতা এসে তোমাকে জড়িয়ে ধরে এবং তা তোমার শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে। তুমি হাই টোল এবং আশ্চর্যান্বিত হও: ‘এটা কী দুঃস্বপ্ন?’ চোখের পাতা বন্ধ করা এবং পুনরায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার আগে তা ছিল তোমার শেষ সম্বল। প্রস্রাবে তোমার মূত্রাশয় পরিপূর্ণ। তুমি তলপেটে চাপ অনুভব করছো এবং প্রত্যাশিতভাবে বুঝতে পারছো যে, সকাল হয়ে গেছে।
×