ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ এসব ওষুধ ধ্বংসের নির্দেশ হাইকোর্টের ;###; ওষুধ প্রশাসনের গণবিজ্ঞপ্তি সত্ত্বেও বাজারে নিষিদ্ধ ওষুধ ;###;জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না ॥ স্বাস্থ্যমন্ত্রী

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ॥ রাজধানীর ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে এখনও

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২৯ জুন ২০১৯

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ  ॥ রাজধানীর ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে এখনও

নিখিল মানখিন ॥ নিষিদ্ধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। কোথাও টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়নি নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ পর্যন্ত মোট ৮৬ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করা হয়েছে। আর সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ বহু ওষুধ ধরা পড়েছে। এভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও লাইসেন্স বাতিল হওয়া কোম্পানি ও ওষুধ বিষয়ে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক চিকিৎসক, এমনকি খুচরা ওষুধ বিক্রেতা কেউ কোন ধারণাই রাখেন না। এদিকে জনবল সঙ্কটে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষেও সারাদেশের হাজার হাজার ফার্মেসি ঘুরে দেখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ সুযোগে নানা কৌশলে লাইসেন্স বাতিল হওয়া অনেক কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তালিকা না থাকায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে নিষিদ্ধ ওষুধ লিখে যাচ্ছেন অনেক চিকিৎসক। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে সারাদেশের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিচালিত এক প্রতিবেদনে রাজধানীর শতকরা ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে ও বিক্রি হচ্ছে বলে এক সেমিনারে জানানো হলে, সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। উচ্চ আদালত শীঘ্রই বাজার থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ওষুধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বিভিন্ন ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থাকাটা অস্বাভাবিক। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যে কোন ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ফার্মেসিগুলো তা একটি নির্দিষ্ট কন্টেনারে মজুদ রাখে এবং ওই কন্টেনারে ‘এ ওষুধ বিক্রির জন্য নয়’ লেখা থাকে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে শতকরা ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা মোটেই সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ যেন কোথাও বিক্রি না হয়, সেজন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সব সময় সতর্ক রয়েছে। এসবের দায়ে গত ছয় মাসে এ সংক্রান্ত ৩৭০ মামলা ও ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সব ক’টি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংসের নির্দেশ হাইকোর্টের ॥ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের মজুত ও বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৮ জুন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এই আদেশ দেয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের গণবিজ্ঞপ্তি জারি ॥ রাজধানীসহ সারাদেশের ফার্মেসি থেকে আগামী ২ জুলাইর মধ্যে সব ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিও আমদানিকারকদের কাছে ফেরত দেয়ার জন্য ফার্মেসিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, এ সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি ও জারি হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফার্মেসিতে বিক্রয়ের উদ্দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মজুদ সংরক্ষণ করা যাবে না। সংরক্ষিত অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেলে ফার্মেসির লাইসেন্স বাতিল ও সিলগালাসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ফার্মেসি পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ফার্মেসি পরিদর্শনপূর্বক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ শনাক্ত করে তার রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ অনধিক ১০ দিনের মধ্যে উৎপাদনকারী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস আগে ফার্মেসি মালিকরা ওষুধগুলো ফেরত প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট ওষুধ উৎপাদনকারী বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ক্রেতাদেরও ওষুধ ক্রয়ের সময় মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখে নিতে গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। কোন ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয় করা হলে কিংবা বিক্রয় প্রস্তুাব করলে ওই ফার্মেসির বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অথবা ওষুধ প্রশাসনের জেলা বা বিভাগীয় কার্যালয়ে অভিযোগ দাখিলের জন্য বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ করা হয়। ওষুধের মেয়াদ সংক্রান্ত কোন অনিয়ম (মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ঘষামাজা বা কেটে ম্যাপ পরিবর্তন) ইত্যাদি পরিলক্ষিত হলে সে সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অথবা ওষুধ প্রশাসনের জেলা/বিভাগীয় কার্যালয়ে অবহিত করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কোথাও যেন বিক্রি না হয় সেজন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখছে, রাখবে বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, যে কোন ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের ওষুধ নেয়াই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। মানবহির্ভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, ভেজাল রোধ করতে হলে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। যে কোনভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। জেলা পর্যায়ে সম্ভব না হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র গড়ে তুললেই হবে না, জনবল ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে ল্যাবগুলো গতিশীল করে তুলতে হবে। এ বিষয়ে যথাযথ সরকারী সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোম্পানিকে সঠিক মানের ওষুধ বানাতে বাধ্য করতে হবে। শুধু তাই নয়, ওষুধ প্রশাসনের লোকজন যাতে প্রভাবিত না হতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ল্যাব হবে পুরোপুরিই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশে এখনও ভাল ওষুধ কোম্পানির সংখ্যাই বেশি। তবে কিছু কিছু কোম্পানি মানহীন ওষুধ তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
×