ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

নেইমারের অপেক্ষায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৮ মার্চ ২০১৮

নেইমারের অপেক্ষায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা

চার বছর আগে বিশ্বকাপের দুঃস্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি ব্রাজিলিয়ানরা। ঘরের মাঠে কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে পিঠে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন নেইমার। দলের সেরা তারকার অনুপস্থিতিতে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরে বিধ্বস্ত হয় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে সেই ক্ষত জুড়ানোর স্বপ্ন বুনছে পেলের দেশ। এই মিশনে প্রধান ভরসা নেইমারই। সেই কিনা আবারও গুরুতর চোটে পড়েছেন। ক্লাব দল পিএসজির হয়ে ফরাসী লীগ ওয়ানের ম্যাচে মার্শেইয়ের বিরুদ্ধে আঘাত পান সাবেক বার্সিলোনা তারকা। যে কারণে বিশ্বকাপের আগে নেইমারের আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাই তো ব্রাজিল ও বিশ্বজুড়ে আবারও চিন্তিত ভক্ত-সমর্থকরা। তবে এই ইনজুরি নাকি পিএসজি তারকার জন্য শাপেবর হয়েছে। কারণ হিসেবে সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা পেলে জানিয়েছেন, এর ফলে নেইমার বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে ভালভাবে প্রস্তুত করার সময় পাবে! তার মানে, বিশ্বকাপের জন্য নেইমারের ইনজুরিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে বলে যে দাবি করছে অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে নেইমারের। বর্তমানে নিজস্ব প্রাসাদে পুনর্বাসনে আছেন তিনি। তার এই বিশ্রামকে রাশিয়ার বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি বলে মনে করছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে। তিনি বলেন, নেইমার এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। চোট পেলেও বিশ্বকাপের আগে সুস্থ হয়ে যাবে সে। ক্লাব ফুটবল থেকে মনোনিবেশ সরিয়ে কখন ব্রাজিলের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে, তা সে জানে। রাশিয়া বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে সেভাবেই তৈরি করছে নেইমার। বিশ্বকাপের আগে ভালভাবে বিশ্রাম নিয়ে সতেজ হয়ে মাঠে নামবে সে। তবে ফরাসী ক্লাব পিএসজির কর্মকর্তাদের দাবি ভিন্ন। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন তারা। তাদের মতে, বিশ্বকাপের কথা ভেবে নেইমারের চোট যতটা, তার চেয়ে বেশি করে দেখাচ্ছেন ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের চিকিৎসকরা। ফরাসী সংবাদমাধ্যমে সরাসরি অভিযোগ তুলে পিএসজি কর্মকর্তারা বলেন, নেইমারের চোট বড় করে দেখাচ্ছে ব্রাজিল জাতীয় দলের চিকিৎসক লাসমার। বিশ্বকাপে সতেজ ও ফিট নেইমারকে পেতেই সম্ভবত এভাবে অতিরিক্ত বিশ্রামে রাখা হয়েছে তাকে। পিএসজির চিকিৎসকরা নেইমারের ডান পায়ের পাতায় কনিষ্ঠার হাড়ে চিঁড় ধরার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু ব্রাজিলের চিকিৎসকরা পরে জানায়, ডান পায়ের পাতায় মেটাটারসাল হাড় ভেঙেছে। ফলে অস্ত্রোপচারের কারণে তিন মাসের জন্য মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাকে। এমন বাজে অবস্থাতেও মনোবল হারাচ্ছেন না নেইমার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে তিনি লিখেছেন, ‘বাধা আপনাকে থামাতে পারবে না। যদি একটি দেয়ালের সামনে পড়েন, হাল ছাড়বেন না। দেয়ালটা বেয়ে উঠার পথ খুঁজে বের করুন।’ আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, নেইমার নাকি এই ইনজুরি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। সব বাধা পেরিয়ে তিনি নাকি ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন বুনছেন। ফুটবলই যে দেশের ধ্যান জ্ঞান, সেখানে বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ আসরে দেশ সেরা খেলোয়াড়ের খেলা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলে পুরো দেশই আশাহাত হবে, এটাই স্বাভাবিক। রাশিয়া বিশ্বকাপকে সামনে রেখে নেইমারের ইনজুরি তাই যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা ফুটবল পাগল ব্রাজিল। বিশেষ করে চার বছর আগে ঘরের মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সেলেসাওদের নিয়ে এবার বেশ আশাবাদী সমর্থকরা। নেইমারের ইনজুরি এতটাই পুরো দেশকে ভাবিয়ে তুলেছে যে সাধারণ জনগণ তো বটেই সংবাদমাধ্যমেও এটা নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় বইছে। স্থানীয় রেডিও ব্যান্ড নিউজ এফএম’এ এক ধারাভাষ্যকার তো বলেই ফেলেছেন, ‘গত রবিবার আমরা আমাদের বিশ্বকাপ হারিয়ে ফেলেছি।’ গুরুতর ইনজুরিতে বিশ্বের সবচেয়ে দামী ফুটবলারের এখন বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্রাজিলিয়ানরা প্যারিসের ক্লাবটি নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়, তাদের পুরো দৃষ্টি বিশ্বকাপকে ঘিরে। এবার যে রেকর্ড ষষ্ঠবারের শিরোপা ঘরে তোলার মিশনে ব্রাজিল লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছে। বাছাইপর্বে প্রথম দল হিসেবে দুর্দান্ত ফর্মে থেকে বিশ্বকাপের টিকেট পাওয়া ব্রাজিলকে নিয়ে অন্যরকম এক উদ্দীপনা কাজ করেছে। এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে সময়ের অন্যতম সেরা তারকা নেইমার। দেশ ও ক্লাবের জার্সিতে সম্ভাব্য সব শিরোপাই জেতা হয়ে গেছে তার। শুধু বাকি স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি। ২০১৪ সালে নিজ দেশে সেমিফাইনালে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। তবে এবার ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে চান ২৫ বছর বয়সী এই সুপারস্টার। এবারের বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স প্রদর্শন করে ব্রাজিল। রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা সবার আগে বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করে। কোচ টিটে দলকে গড়ে তুলেছেন দুর্দান্তভাবে। একই পজিশনে একাধিক চৌকষ খেলোয়াড় থাকায় আসছে বিশ্বকাপে হট ফেবারিট পেলের দেশ। তাইতো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন নেইমারও। এক সাক্ষাতকারে পিএসজি তারকা জানিয়ে দিয়েছেন জুন-জুলাইয়ে বিশ্বকাপ জেতাটাই তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ব্রাজিলে যুগে যুগে এসেছে পেলে, গ্যারিঞ্জা, ভাঁভা, পেরেইরা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডোনিহো, কাকা, রবিনহোর মতো ফুটবলার। এসব তারকাদের উদ্ভাসিত নৈপুণ্যে বরাবরই সাফল্য দেখিয়ে এসেছে ব্রাজিল। দেশটির সাফল্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, ব্রাজিল এবং ফুটবল একে অপরের পরিপূরক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সাফল্যের পাশাপাশি বিশ্বের সেরা আয়োজন বিশ্বকাপেও সেরা দলের তকমা ব্রাজিলের। কেননা রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী তারা। সাফল্যের পরিসংখ্যানে এমন অবস্থা ব্রাজিল মানেই সেরা হওয়া। ‘দ্বিতীয়’ হওয়াটাকেও দেশটি ব্যর্থতা হিসেবে মনে করে। ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর দীর্ঘ দুই পর ১৯৯৪ সালে আবারও বিশ্বকাপ জেতে জাগো বনিতোরা। আধুনিক যুগে এসে এ সময় থেকেই মূলত দেশটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ১৯৯৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত টানা তিন বিশ্বকাপে ১২ বছর বিস্ময়কর সাফল্য দেখায় ব্রাজিলিয়ানরা। এ সময়ের তিনটি বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই ফাইনালে খেলে ব্রাজিল এবং দুটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। এমন আকাশচুম্বী সাফল্যের পর ব্রাজিল দল যেন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এ কারণেই ২০০৬ বিশ্বকাপে ‘হেক্সা‘ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে জার্মানি পাড়ি জমায় লুই ফিলিপ সোলারির দল। এ সময় রোনাল্ডিনহোরা এতটাই ফর্মের তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন যে বিশ্বকাপ জয় করা নিয়ে কোন সংশয় ছিল না। কিন্তু চূড়ান্ত লড়াইয়ে খেই হারিয়ে বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে। এরপর দলের দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কার্লোস দুঙ্গাকে। ২০০৯ সালে কনফেডারেশন্স কাপ জয় করে তিনিও স্বপ্ন দেখিয়েছেন ষষ্ট শিরোপা জয়ের। কিন্তু দলের সেরা ফুটবলারদের বিশ্বকাপে না এনে তথাকথিত ‘শ্রমিক‘ দিয়ে শিল্পকর্ম করতে যেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর স্বাভাবিকভাবেই অপসারিত হতে হয় এই লৌহমানবকে। ২০১৪ বিশ্বকাপে নিজ দেশে ব্যর্থ হয় পেলের দেশ। টানা তিন বিশ্বকাপে ব্যর্থ হওয়া ব্রাজিলের এখন পাখির চোখ ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে।
×