ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের ক্রিকেটে অশনিসঙ্কেত!

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

দেশের ক্রিকেটে অশনিসঙ্কেত!

এমন লজ্জার শিকার আগে হতে হয়নি। টানা তিন ম্যাচেই প্রতিপক্ষ রেকর্ড গড়েছে দেখা হয়নি এমনটা। কিন্তু এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। টেস্ট সিরিজে প্রত্যাশা একেবারেই না থাকলেও বিনা যুদ্ধে প্রোটিয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ ছিল অভাবনীয়। আর ওয়ানডে সিরিজে প্রত্যাশার পারদ ছিল উচ্চমুখী। কিন্তু সেই ওয়ানডে সিরিজেও হয়েছে ভরাডুবি। টানা তিন ম্যাচে রেকর্ড গড়ে জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই প্রথম কোন প্রতিপক্ষ দল তিন ম্যাচের সিরিজে সর্বমোট ১০০০ রানের বেশি করেছে যা এর আগে মাত্র তিনটি দলের ললাটে লেখা হয়েছিল। প্রথম ওয়ানডেতে সর্বাধিক রান তাড়া করে ১০ উইকেটে জেতার বিশ্বরেকর্ড গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা, দ্বিতীয় ম্যাচে ৩৫৩ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ১০৪ রানে জয় পায় এবং তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে আরও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ হেরেছে ২০০ রানের লজ্জাজনক ব্যবধানে। সেই ম্যাচে প্রোটিয়ারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্ক ভেন্যুতে সর্বাধিক রানের রেকর্ড গড়েছে। ক্রমোন্নতির গ্রাফ যখন ঊর্ধ্বমুখী, যখন সবাই বাংলাদেশকে ভীতিকর একটি দল হিসেবে সমীহ করতে শুরু করেছে সেই সময়ে এমন পরাজয় ভাগ্যে জুটেছে। এ কারণে ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ভবিষ্যতে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের জন্য অশনিসঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন। তিনি মনে করেন ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে উন্নতি করতে না পারলে ফলাফল বিপর্যয় ঘটবে আরও। এমন লজ্জার রেকর্ডে নাম লেখাবে বাংলাদেশ, কেউ ভেবেছে কখনও? বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতে ২৮২, দ্বিতীয়টিতে ৩৫৩ আর তৃতীয় ম্যাচে ৩৬৯ রান করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। যার মোট দাঁড়িয়েছে ১০০৪ রান। তিন ম্যাচ সিরিজে হাজার রান হজম করার রেকর্ডে চতুর্থ নাম এখন বাংলাদেশের। প্রথমবারের মতো এমন লজ্জার রেকর্ডের ভাগীদার হয়েছে বাংলাদেশ। তবে তাদের আগে আরও তিনটি দেশ তিন ম্যাচ সিরিজের ম্যাচে এই রেকর্ড করেছে। সে দলগুলো হলো-ভারত, ইংল্যান্ড ও জিম্বাবুইয়ে। মাত্র কিছুদিন আগে ভারত-ইংল্যান্ডের সিরিজে ১ হাজার রান হজমের রেকর্ড হয়েছে। গেল জানুয়ারিতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই সিরিজে ইংল্যান্ড হজম করেছে ১০৫৩ রান। বিপরীতে ভারতীয় বোলারদের গুনতে হয়েছে ১০৩৭ রান। সে তুলনায় বাংলাদেশ কিছুটা ভাল অবস্থানেই আছে। তবে ঠিকই একই কাতারে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আরও নাম আছে জিম্বাবুইয়ের। দক্ষিণ আফ্রিকাই জিম্বাবুইয়েকে এই রেকর্ডের লজ্জায় ডুবিয়েছিল। ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে জিম্বাবুইয়েকে হজম করতে হয়েছিল ১০২৩ রান। তবে এই সিরিজের আগে আগে তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ কখনও ৯০০ রানও হজম করেনি। ২০১১ সালে সর্বোচ্চ ৮৬৩ রান হজম করেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এবার নিজেদের সর্বকালের সকল রেকর্ড ভাঙ্গল বাংলাদেশ দল। সফরের শুরু থেকেই বেহাল বোলিং নিয়ে ছিল আলোচনা। সেটা সময়ের সঙ্গে আরও দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশী বোলারদের অনিয়ন্ত্রিত ও আলগা বোলিংয়ের সুবাদে রবিবার ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্কে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে ভেন্যুর সর্বাধিক রানের রেকর্ড গড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ৬ উইকেটে ৩৬৯ রান তোলে তারা। এটি আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। বাফেলো পার্কে এর আগে হওয়া ৪৩ ওয়ানডেতে মাত্র ৩টি তিন শতাধিক রানের দলীয় ইনিংস দেখা গেছে। ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭ উইকেটে ৩১১ রান করেছিল প্রোটিয়ারা। সেটাই ছিল এই ভেন্যুর সেরা। এবার সেটিকে ছাড়িয়ে গেল তারা। ওয়ানডেতে এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিপক্ষের চতুর্থ সর্বাধিক সংগ্রহ। অর্থাৎ সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে সফরকারী বোলাররা নিজেদের দৈন্যদশা আরও প্রকটভাবেই ফুটে তুলেছেন। প্রথম ওয়ানডেতে বোলারদের চরম ব্যর্থতায় সর্বাধিক রান তাড়া করে বিনা উইকেটে জিতে যাওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়ে প্রোটিয়ারা। পার্লে হওয়া দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তোলে ৬ উইকেটে ৩৫৩ রান। এবার সেটিকেও ছাড়িয়ে ৬ উইকেটে ৩৬৯ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্কে আজ পর্যন্ত এটিই ওয়ানডের সেরা সংগ্রহ কোন দলের। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এটি প্রোটিয়াদের সর্বাধিক সংগ্রহ। এর আগে ২০০৮ সালের ৯ নবেম্বর বেনোনিতে ৪ উইকেটে ৩৫৮ রান তুলেছিল তারা। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে সর্বাধিক ৪ উইকেটে ৩৯১ রান করে ইংল্যান্ড আছে সবার উপরে। ২০০৫ সালের ২১ জুন নটিংহ্যামে সেটি করেছিল তারা। এছাড়া পাকিস্তানের ৭ উইকেটে ৩৮৫ (ডাম্বুলা, ২০১০), ভারতের ৪ উইকেটে ৩৭০ (ঢাকা- ২০১১) এগিয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ইনিংসের চেয়ে। বোলিংয়ের অবস্থা চরম বাজে হলেও ব্যাটিংটা মোটামুটি ভালই হচ্ছিল বাংলাদেশ দলের। কিন্তু তৃতীয় ওয়ানডেতে ব্যাটিংয়েও ব্যর্থতা দেখা গেছে। পুরো সিরিজেই প্রোটিয়া পেসারদের কাছে অসহায় অবস্থায় ছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। সেটা প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে দেখা গেছে খুব ভয়াবহ রূপে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বনি¤œ টেস্ট সংগ্রহ ৯০ রানে গুটিয়ে যায়। ১০ বছরের মধ্যে সেটা ছিল বাংলাদেশের সর্বনি¤œ রান। তবে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে সেটা কাটিয়ে ওঠেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু তৃতীয় ওয়ানডেতে আবার বিভীষিকাময় ব্যাটিং। এবার ১৬৯ রানেই গুটিয়ে যাওয়ার পেছনে ছিলেন অনভিজ্ঞ পেসার ড্যান প্যাটারসন। তিনি ৫ উইকেট শিকার করে ধসিয়ে দেন বাংলাদেশের ইনিংস। অথচ, দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ব্যাটিং করেছে তখন এটিকে ব্যাটিং স্বর্গই মনে হয়েছে। শুধুমাত্র পেস ভীতির কারণেই যেন ভেঙ্গেচুরে যায় বাংলাদেশ দল। নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বাজে বোলিং গড় ছিল বাংলাদেশ দলের। সিরিজের শুরুতে দুই ম্যাচের টেস্ট থেকেই এই বোলিং দৈন্যতা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। তার সঙ্গে ব্যাটিং ব্যর্থতা যোগ হয়। সে কারণে পঞ্চমবার ১০ উইকেটে হার এবং চতুর্থবার ২০০ বা তারচেয়ে বেশি রানে হারের লজ্জা বরণ করে। আরও বেশি সতর্কভাবে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার সমাধান বের করা জরুরী বলে মনে করেন মাশরাফি। তিনি বলেন, ‘এই সফরটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড় ধরনের সঙ্কেত। অনেক দ্বিপাক্ষিক সফর এগিয়ে আসছে এবং বিশ্বকাপও এগিয়ে আসছে। সুতরাং এই বিষয়গুলো বেশ সতর্কভাবে তত্ত্বাবধান করে দ্রুত সম্মিলিত একটি দল হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।’ টানা দুর্দান্ত খেলার পরও এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এমন বাজে নৈপুণ্য দেখাবে বাংলাদেশ দল সেটা ছিল সকলেরই ভাবনাতীত। জয়-পরাজয় মুখ্য ব্যাপার নয়, কিন্তু নিজেদের সেরাটা দিয়ে প্রচেষ্টা চালানোই প্রত্যাশিত ছিল। সেটাও পারেনি বাংলাদেশ দল। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমরা ব্যাটিং-বোলিং করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। আমরা কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারিনি। ব্যাটসম্যান কিংবা বোলার কেউ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারেনি। আমার মনে হয় নির্দিষ্ট খেলোয়াড় অনুসারে আমাদের বিষয়টা খুঁজে বের করতে হবে যে কেন আমরা ভাল খেলতে পারলাম না। আমার মনে হয় না শুধুমাত্র প্রচুর অনুশীলন করে এর সমাধান করা সম্ভব হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদী একটা প্রক্রিয়া। আমাদের এ ধরনের উইকেটে খেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যখন পরবর্তীতে আমরা বিদেশ সফর করব। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে সাধারণত এই ধরনের ফ্ল্যাট উইকেটগুলোই বানানো হয়। তাই যেসব উইকেটে নিয়মিত ৩০০/৩৫০ রান হয় সেখানে কিভাবে বল করতে হবে সেটা বোলারদেরই ভেবে বের করতে হবে।’ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের এই শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে নিজেদের ফিরে পাওয়াটাই এখন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ দলের জন্য আগামীতে।
×