ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মহাশূন্যে মহাযাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৯ অক্টোবর ২০১৭

মহাশূন্যে মহাযাত্রা

টানা ৩৪০ দিন মহাকাশে কাটিয়ে আসা মার্কিন নভোচারী স্কট কেলীযেন বিজ্ঞানের এক জীবন্ত পরীক্ষা। মহাকাশের কঠিন পরিবেশে শরীরের প্রতিক্রিয়া কি হয় এবং সেই পরিবেশের সঙ্গে শরীর কিভাবে খাপ খাইয়ে নেয়, তা জানার জন্য গবেষকরা কেলীর সব কাজকর্ম, আচার আচরণ মনিটর করেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রেস স্টেশনে থেকে পৃথিবীকে ৫৪৪০ বার প্রদক্ষিণ, ১৪ কোটি ৪০ লাখ মাইল পথ পরিক্রমা এবং তিনবার মহাশূন্যের বুকে পদচারণার পর তিনি ২০১৬ সালের মার্চে মর্ত্যরে বুকে ফিরে এসেছেন। সুদীর্ঘ সময় মহাশূন্য যাত্রার অভিজ্ঞতার ওপর তিনি একটি বই লিখেছেন, নাম এনডিউরেন্স। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অক্টোবরে প্রকাশিত সেই বইয়ের কিছু উদ্ধৃতাংশ তুলে ধরেছে, যেখানে কেলী দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার শারীরিক ও আবেগগত চ্যালেঞ্জগুলো ব্যক্ত করেছেন। পৃথিবী থেকে ২শ’ মাইল ওপরের মহাশূন্য থেকে এই গ্রহটিকে খুব অন্তরঙ্গভাবে দেখেছিলেন কেলী। এর সমুদ্রে উপকূলরেখা, পাহাড়-পর্বত, সমভূমি, নদ-নদী সবকিছুই দেখেছেন। বিশ্বের কিছু কিছু অংশ বিশেষ করে এশিয়ার কিছু অংশ বায়ুদূষণের কারণে এতই ঝাপসা দেখায়, যেন সেটা এক রুগ্ন ব্যক্তি যার চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে মহাশূন্য থেকে বাহামাকে দেখতে পাওয়া কেলীর প্রিয় দৃশ্যগুলোর একটি। স্পেস স্টেশনে একটা মডিউল আছে যার নাম কুপোলা। পুরোটাই কাপোলার। তা থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখা যায়। কেলী এর আগে তিনবার মহাকাশ অভিযানে গেছেন। আর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন বা আইএসএসে গেছেন দ্বিতীয়বার। মহাকাশে প্রথম প্রথম যখন ঘুম থেকে জেগে উঠতেন নিজের শরীর অবস্থান নিয়ে অনেক সময় কোন দিশা পেতেন না। তবে তিনি নিশ্চিত থাকতেন শরীরটা হয়ত উল্টো হয়ে আছে। আইএসএসের ক্রুদের কোয়ার্টারগুলো কেলীর নিজের জন্য যথেষ্ট বড় মনে হতো। সেখানে থাকত সিপিং ব্যাগ, দুটো ল্যাপটপ, কিছু কাপড়চোপড়, টয়লেটসামগ্রী, তার দীর্ঘদিনের বান্ধবী ও কন্যাদের ছবি এবং গুটিকয়েক পেপারব্যাক বই। স্লিপিং ব্যাগ থেকে না বেরিয়ে এসেই তিনি দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা দুটো কম্পিউটারের একটি চালু করে দিয়ে তার দৈনন্দিন কাজকর্মের সিডিউল দেখে নিতেন। কেলী আইএসএসের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে আইএসএস হলো এ যাবতকালের সৃষ্ট সবচেয়ে ব্যয়বহুল বস্তু। আইএসএসই একমাত্র বস্তু যার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন দেশে তৈরি এবং তারপর সেগুলো মহাশূন্যে সংযোজিত। এর অন্তর্মহল আছে, বহির্মহল আছে। রুমের ওপর রুম আছে। প্রতিটির ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আছে তার নিজস্ব সাজসরঞ্জাম। তার নিজস্ব অনুভূতি ও ঘ্রাণ, যা প্রতিটি থেকে আলাদা। বাইরে থেকে দেখলে আইএসএসকে একটার সঙ্গে একটার প্রান্ত সংযুক্ত কয়েকটি বিশাল বিশাল খালি সোডার ক্যানের মতো দেখায়। আয়তনে মোটামুটি একটি ফুটবল মাঠের সমান এই মহাকাশ কেন্দ্রটি লম্বালম্বিভাবে যুক্ত পাঁচটি মডিউল দিয়ে তৈরি। এর তিনটি আমেরিকার, দুটি রাশিয়ার। ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আরও কিছু মডিউল পোর্ট ও স্টারবোর্ডের বাড়তি অংশ হিসেবে সংযোজিত। রাশিয়ার আরও তিনটি মডিউল ওপর ও নিচের দিকে যুক্ত। এগুলো যে এলোমেলোভাবে লাগানো হয়েছে তা নয়, বরং ১৯৯০-এর দশকে স্পেস স্টেশন প্রকল্পের শুরু থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী করা। সফরকারী কোন নভোযান কিছু সময়ের জন্য আইএসএসে এসে ভিড়লে সাময়িকভাবে একটা নতুন রুম পাওয়া যায়। সাধারণত এগুলো হলো কার্গোযান, যা পৃথিবী থেকে নভোচারীদের জন্য মালপত্র নিয়ে আসে এবং ওদের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র নিয়ে যায়। শাটল কর্মসূচী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নাসা বেসরকারী কোম্পানিকে দিয়ে তাদের নভোযানে করে স্পেস স্টেশনে কার্গো পাঠাচ্ছে। ভবিষ্যতের কোন এক পর্যায়ে নতুন ক্রুও পাঠাবে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল প্রাইভেট কোম্পানি হলো স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস, যা স্পেস এক্স নামেই বেশি পরিচিত। তাদের তৈরি নভোযানের নাম ড্রাগন। পৃথিবী থেকে কার্গো যান আইএসএস কাছাকাছি এলে স্টেশনের নভোচারীদের লক্ষ্য থাকে স্টেশনের রোবট বাহু দিয়ে সেটাকে ধরে ডকিং পোর্টে লাগিয়ে দেয়া। এই কাজটা যে খুব সহজ ও নিরাপদ, তা ভাবার কোন কারণ নেই। একটা ভুলের জন্য সেই কার্গো যান এবং এর ভেতরের লাখ লাখ ডলার মূল্যের রসদসামগ্রীর শুধু ক্ষতি হতে পারেই না, হাত ফসকে গেলে কার্গো যানটি স্টেশনের গায়ে আছড়েও পড়তে পারে। এমন দুর্ঘটনা পুরনো রুশ স্পেস স্টেশন মির-এ ঘটেছিল। ভাগ্য ভাল ক্রুরা কেউ হতাহত হয়নি। মানবহীন এই নভোযানই পৃথিবী থেকে আইএসএসের আরোহীদের খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠানের একমাত্র উপায়। স্পেসএক্সের ড্রাগন ছাড়াও রাশিয়ার প্রোগ্রেসও কাজ করে থাকে। পৃথিবী থেকে আনা রসদপত্রের মধ্যে থাকে খাবার, পানি ও অক্সিজেন, যা নভোচারীদের বাঁচিয়ে রাখে। আর থাকে স্পেস স্টেশনের খুচরা অংশ ও অন্যান্য সরবরাহ। নভোচারীদের জন্য খাবার ছাড়াও আনা হয় রক্ত পরীক্ষার জন্য সুঁই, ভ্যাকুয়াম টিউব, স্যাম্পল কন্টেনার, ওষুধ, পোশাক, টাওয়েল ও ধোয়া-মোছার কাপড়। যতটা সম্ভব ব্যবহার করার পর নভোচারীরা সেগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর উপকরণও আনা হয়। যেমন, তারা জ্যান্ত ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন কিভাবে ওজনহীন অবস্থা হাড় ও পেশীর ওপর প্রভাব ফেলে। প্রতিবার নতুন কার্গো তাজা খাবার নিয়ে আসে। এই তাজা খাবারের স্বাদ নভোচারীরা বেশিদিন উপভোগ করতে পারে না। কারণ পৃথিবীর তুলনায় স্পেস স্টেশনে তাজা খাবার বিশেষত ফলমূল তাড়াতাড়ি পচে যায়। স্পেস স্টেশনে পোশাক পরা ও বদলানো এক ঝকমারি ব্যাপার। কারণ যথার্থ অর্থে ওতে ‘বসা’ বা ‘দাঁড়ানো’ যায় না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোজা পরা। কারণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি না থাকায় ঝুঁকে পড়াটা মুশকিল। সে জন্য পা দুটো সর্বশক্তি দিয়ে বুক পর্যন্ত তুলে এনে মোজা পরতে হয়। জুতার ফিতা বাধার কাজটাও তদ্রƒপ কঠিন। জিরো গ্র্যাভিটি এই কাজগুলোকে কঠিন করে তোলে। কেলী ৩৪০ দিনের মধ্যে তিনবার মহাশূন্যে পদচারণা করেছেন। একবার ৭ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। সেটা ২০১৫ সালের নবেম্বর মাসে। একটি কুলিং ইউনিটকে রিকনফিগার করার জন্য তাকে এ কাজটা করতে হয়েছিল। কেলী এ সময় স্পেস স্টেশনের সঙ্গে নিরাপদে বিশেষ দড়ি দিয়ে বাধা ছিলেন। পরিধেয় স্পেস স্যুটই এ সময় তাঁকে তেজস্ক্রিয়তা এবং মহাশূন্যের অন্যান্য বিপত্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×