ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

একশ’ দিনের সাফল্য-ব্যর্থতার খেরো খাতা

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

একশ’ দিনের সাফল্য-ব্যর্থতার খেরো খাতা

বৈশ্বিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে নতুন নতুন সংকটে

বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনীতিতে নানা অনিশ্চয়তা ও সংকটের আশঙ্কা থাকলেও গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার কথা বলেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। এর মধ্যে রয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। প্রভাবশালী এসব পাশ্চাত্য দেশের সরকারগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জোরালো ইচ্ছা প্রকাশ করেছে

বৈশ্বিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে নতুন নতুন সংকটে সৃষ্ট একগাদা অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে। সে হিসাবে চলতি এপ্রিলের ২১ তারিখ এই সরকার তার প্রথম ১০০ দিন পূরণ করেছে। ১,৮২৫ দিনের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার অনুমোদন পাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের প্রথম ১০০ দিনের কার্যক্রম দিয়ে সাফল্য ও ব্যর্থতা নিরূপণ করা সহজ নয়।

তবু সকাল দেখেই যেমন আঁচ করা যায় দিনটি কেমন যাবে, তেমনি এই ১০০ দিনে কিছুটা হলেও বোঝা যেতে পারে যে, সাফল্য-ব্যর্থতার নিক্তিতে সরকারের অবস্থান কোথায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, মেয়াদের হিসাবে সরকার নতুন হলেও প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেছে।

এই বিচারে এই সরকারের প্রথম দিকের সকাল ভালো না হওয়ার পেছনে বড় কোনো যুক্তি দাঁড় করানো কষ্টকর। এমন এক প্রেক্ষাপটে নির্মোহ পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি ও মূল্যায়ন বলছে, সরকার দেশের মানুষের মনে জেঁকে বসা জাতীয় অর্থনীতির কালো মেঘের ঘনঘটা কিছুটা সরিয়ে ফেলেছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর ইচ্ছা দেখিয়েছে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর-মাত্রায় ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে।

সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দূর করতে পেরেছে। যার ইতিবাচক-নেতিবাচক ফল দৃশ্যমান হতে আরও কিছু সময় লাগবে। তবে সমাজের সর্বস্তরে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সাফল্য ও পদক্ষেপ সরকার এই সময়ে দেখাতে পারেনি। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারপ্রধানের নানা চেষ্টা, উদ্যোগ ও সদিচ্ছা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার ব্যর্থতা ১০০ দিনের পাস মার্ক পাওয়াকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে।

অবশ্য এ কথাও ঠিক, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কবলে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশের আর্থিকীকরণকৃত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাজারের নৈরাজ্য নিরসন করা মাত্র ১০০ দিনের কাজ নয়।
টানা চতুর্থ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ১০০ দিনের খেরো খাতা বিশ্লেষণ করার আগে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের প্রথম বছর ও পরবর্তী কিছু সময়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। কারণ, সেই সময়ের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা স্বাধীনতাপরবর্তী ৪৮-৪৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিরুপদ্রপ ছিল বলে অনেকেই মনে করে। সে সময় এই পর্যায়ে গিয়ে সরকারকে শুরুতেই নানা অস্বস্তিকর ঘটনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।

বিশেষ করে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সড়ক পরিবহনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্ট, ছাত্র আন্দোলন, বুয়েটে আবরার হত্যাসহ আরও কয়েকটি  হত্যাকা- এবং বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি ও দলীয় ব্যানারে ক্যাসিনো কা-ের ঘটনা সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনার ফলে সেসব সংকট সরকার দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল। ফলে অর্থনীতির অঙ্গনেও সুবাতাস বইছিল, প্রবৃদ্ধিও ক্রমবর্ধমান ছিল। 
তবে এর পরপরই শুরু হয় অভূতপূর্ব বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর মহাবিপর্যয়কাল। কোভিড নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেলেও আর্থিক প্রণোদনার অর্থ নিয়ে পরজীবী অর্থলোভী ব্যক্তি ও পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছিল। এর পরপরই ২০২২ সালে শুরু হয় ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। সংকটকে আরও গভীর করে ২০২৩ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ।

সব মিলিয়ে তৃতীয় মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বৈশ্বিক ঘটনার প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তায় বলা যায় অনেকেটাই ছিল পর্যুদস্ত। এ অবস্থার মধ্যেই  আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদের ৫ বছর পূর্ণ করে এবং ২০২৪ সালে নতুন করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসীন হয়।
চতুর্থ মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনের সফলতা-ব্যর্থতা যাচাইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আলোকপাত করা যেতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশ থিমে ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে ঘোষিত ওই ইশতেহারে জনগণের মনোভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ অগ্রাধিকারের শুরুতেই রাখা হয় দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার বিষয়টি।

২০১৯ সালে তৃতীয় মেয়াদের ইশতেহারে তরুণদের জনশক্তিতে রূপান্তর, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য নির্মূল, বিদ্যুৎ-জ্বালানির নিশ্চয়তার বিষয়ে বিশেষ অঙ্গীকার করা হলেও এবার সেসবকে অন্য আঙ্গিকে সন্নিবেশিত করা হয়। মূল লক্ষ্য করা হয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ এবং যুবসমাজকে সম্পৃক্ত রাখা, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ।

একই সঙ্গে একই বিশেষ তালিকায় রাখা হয় ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রসারকে। এক্ষেত্রে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বড় সাফল্য না থাকলেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু পদক্ষেপ এই ১০০ দিনে দেখা গেছে। এসবের নিট ফল কেমন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা সরকারের থাকলেও সংকোচনশীল মুদ্রানীতি ও আর্থিক সংকটের কারণে তা কার্যকর কোনো রূপ পায়নি। তবে বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদে বর্তমান সরকার মৌলিক কোনো উদ্যোগ দেখাতে পারেনি।
দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি বর্তমান সরকারের জন্য ১০০ দিনে বিশেষ করে পবিত্র রমজানের সময় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ বছর দুয়েক ধরে ক্রম-ঊর্ধŸগামী উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতায় কিছুটা রাশ টানতে পারলেও ঈদ ও রোজার কারণে বাড়তি অর্থের প্রবাহ মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত জানুয়ারির তুলনায় মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

জানুয়ারিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। জানুয়ারির তুলনায় মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে হয় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। তবে গত ১৩ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতায় জনগণ কিছুটা স্তস্তিতে থাকলেও পালাক্রমে আলু, পেঁয়াজ, খেজুর ও চিনির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সরকারের সদিচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

চাল, ভোজ্যতেল, গম ও আটার দাম ছিল অপরিবর্তিত। জিরার পাশাপাশি দেশী পেঁয়াজ, দেশী রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদসহ কয়েকটি মসলার দাম বাড়তির ধারায় ছিল না। এই সময়ে সরকারি সংস্থার সুলভে দুধ, ডিম, মাংস কেনার সুযোগ পেয়েছে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। টিসিবির মাধ্যমে পরিচালিত রেশনিং সুবিধায় ১ কোটির বেশি মানুষ কম দামে চাল, ডাল, তেল পেয়েছেন। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরে জীবনযাত্রা পরিচালনার ব্যয় ১ বছরে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই অবস্থায় টিসিবির উদ্যোগ দরিদ্র মানুষের জন্য অনেক সুবিধা বয়ে এনেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাঁর ত্রাণভা-ার থেকে দেশের সব সংসদ সদস্যের মাধ্যমে গরিব মানুষের জন্য সাত ধরনের উপকরণ উপহার হিসেবে দিয়েছেন। শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি ও বিভিন্ন ধরনের পোশাকের এসব উপহার উদ্দিষ্ট মানুষের হাতে পৌঁছে থাকলে সরকারের কল্যাণ ইচ্ছার জয় হবে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জ্বালানি খাত সরকারের বন ও পরিবেশসহ কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১০০ দিনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এমন কোনো কিছু ছিল না। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের স্বাস্থ্য খাতের ভগ্নদশা উদ্ধারে আন্তরিক ইচ্ছা সবার দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও বেসরকারি হাসপাতালে শৃঙ্খলা ফেরাতে তাঁর চেষ্টা  প্রশংসা পেয়েছে।

সেবামূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পরিকল্পনা, অবৈধ হাসপাতাল বন্ধ, স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণ ও দুর্নীতি কমাতে পারলে সরকারের সাফল্যের মাত্রা অনেকটাই বাড়বে। শিক্ষা খাতে নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পুরোপুরি না কমলেও বিভিন্ন সমস্যাকেন্দ্রিক জটিলতা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে। তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংশের শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশনের ছকে ফেলে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগ সরকারের বৈষম্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতিকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

আগামীতে বাজেটে শিক্ষা খাতে প্রত্যাশিত বরাদ্দ এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর সরকারের শিক্ষাসফলতা নির্ভর করছে। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অস্থিরতা ও সংকট কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সরকারের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। জ্বালানি মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগটি ঠিকঠাকভাবে কার্যকর হলে এই খাতে সংকট কমে আসবে।

তবে আমদানিনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে লক্ষ্যযোগ্য কোনো পদক্ষেপ এই সময়ে নিতে দেখা যায়নি। দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রেমিটেন্স এসেছে ১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৭ মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসীরা দেশে ১,৫০৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন, যার মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ২১৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। এর আগের মাস জানুয়ারিতে দেশে প্রবাসী আয় ছিল ২১০ কোটি ডলার। ঈদের মাস এপ্রিলের প্রথম ৫ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলার দেশে এসেছে (প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে ৪,৯৫০ কোটি টাকা)। এটি ভালো লক্ষণ। তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনছে।

এতে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়লেও সরকারি হারের চেয়ে অন্তত চার টাকা বেশি দিয়ে রেমিটেন্স আনার অস্বাভাবিক ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব ক্ষেত্রে কড়া নজরদারি চালাতে হবে। এই অবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে, ডলারের মূল্যমান বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার মতো পরিবেশ বাংলাদেশে এখনো হয়নি। সরকারের প্রথম ১০০ দিনে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়েও ইতিবাচক লক্ষণ দেখা গেছে। বৈশ্বিক নানা সংকটের মাঝেও সরকারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্জন হয়েছে অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ হিসাবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় উপার্জনকারী খাত পোশাক আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২.৪৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত তিন মাসে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ফলে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। সরকারের রপ্তানিমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে।
নানামুখী পদক্ষেপে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা অর্থনীতিকে ঘিরে ধরেছিল তা সরকার কিছুটা হলেও প্রথম ১০০ দিনে নিরসন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আইএমএফ ফর্মুলা অনুযায়ী গত ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১,৯৯৪ কোটি ডলার, যা ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে ১২৯ কোটি ডলার আমদানি  দায় পরিশোধের পর গত ১১ মার্চ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ১,৯৯৮ কোটি ডলার। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় এপ্রিলে রিজার্ভ পরিস্থিতি স্বভাবতই আরেকটু ভালো হয়েছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নিয়ে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য অনেক  বেড়েছে।

এতে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি মাসে পণ্য কেনা বাবদ বাংলাদেশকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার করে দায় পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের  আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদ-ে বাংলাদেশে বর্তমানে চার মাসের আমদানি দায় মেটানোর সামর্থ্য আছে। সরকারকে রিজার্ভ বাড়াতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে অভ্যন্তরীণ কৃচ্ছ্রসাধনে।
বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনীতিতে নানা অনিশ্চয়তা ও সংকটের আশঙ্কা থাকলেও গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার কথা বলেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। এর মধ্যে রয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। প্রভাবশালী এসব পাশ্চাত্য দেশের সরকারগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জোরালো ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনের পরপরই সম্পর্ক জোরদারে ঢাকায় আসেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভাইস মিনিস্টার। জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম ১০০ দিনে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সুইডেনের রাজকন্যা, আয়ারল্যান্ডের বাণিজ্যমন্ত্রী, ভুটানের রাজা, ঘানার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ সফর করেন।

বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের ইতিবাচক প্রচেষ্টা এই সময়ে দেখা গেছে। কাতার, জর্ডান ও মরিশাসে কর্মী পাঠানো চূড়ান্ত হয়েছে। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে রাশিয়ায় শ্রমিক যাওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা সফল হলে কর্মসংস্থান খাতে বিশাল সাফল্য অর্জন হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে।
বিগত তিন মেয়াদে সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক সাফল্য। সে সময় প্রযুক্তি খাতে বিশেষত ডিজিটাইজেশনের মধ্যম সারির সাফল্য সরকার দেখিয়েছে। তবে সেই সময়ে চরম দারিদ্র্য কিছুটা কমলেও নানা কারণে তা এখন বাড়তির দিকে। বৈষম্য ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে নানামাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক সংকটের মাঝেও সরকারের ১০০ দিনের প্রচেষ্টাকে পাস মার্ক দেওয়া যায়।

তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতাবিচারে সরকারের আরও ভালো করা উচিত ছিল। অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার সুযোগে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলমান সংকটের নেতিবাচক প্রভাব সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এবং ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিবিদদের দুষ্ট ত্রিভুজ সরকার ভেঙে দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা দেশে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও আর্থিক অস্থিতিশীলতায় বড়  ভূমিকা রেখেছে।

সরকারকে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক কয়েকটি সমস্যার দ্রুত সমাধান না করতে পারলে অথবা সমস্যা নির্মূলে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো উদ্যোগ নিতে না পারলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের অনেক অর্জনকেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্নতির স্বাভাবিক গতিধারা বিবেচনায় অস্বীকার করতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×