ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রেক্ষিত বৈশাখী তাপপ্রবাহ

ড. শাহনাজ বেগম নাজু

প্রকাশিত: ২০:২০, ৩ মে ২০২৪

প্রেক্ষিত বৈশাখী তাপপ্রবাহ

.

১৪৩১ বঙ্গাব্দ পহেলা বৈশাখ, অন্যান্য বছরের মতো এবারও বাঙালি নানান আয়োজনে বর্ষবরণ করেছে। মূলত, সেদিন  থেকেই বৈশাখের দাবদাহে আমরা নাজেহাল, যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের দেশে যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি, গাড়ি, অফিসে থাকেন/কাজ করেন, তারাও একেক দিনে তীব্র দাবদাহের ছোঁয়া পেয়েছেন। অপরদিকে মজুর-শ্রমিকের মতো খেটে খাওয়া মানুষেরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এখন সবাই একটুখানি নড়েচড়ে বসেছি; সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি, আলোচনা হচ্ছে, যা ইতিবাচক আগামীর ইঙ্গিত দেয়।

জলবায়ুু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যে কোনো  দেশে শতকরা ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৫.৫৮% বনভূমি (পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ২০২৩) গত কয়েকদিনে  দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪৩. ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা তো সবে শুরু, আগামীতে তাপমাত্রা ৫৬ ডিগ্রি  সেলসিয়াস হলে কি হবে? মানুষের বাঁচা মুশকিল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ। 

বন উজাড় হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে রাস্তার বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে, যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটের ভাটিগুলো গিলে ফেলছে সবুজ, কৃষি জমি জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঋঅঙ-এর তথ্য অনুসারে, ২০১০  থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর . মিলিয়ন  হেক্টর বনভূমি কমেছে। অপরদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দুটি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল, এই দুটি পদার্থের ব্যবহার এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। প্রেক্ষিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে একবার করে ৩০ কোটি মানুষ বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে (উৎস: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মাসিক বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকীনেচার কমিউনিকেশন’) এই গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বায়ুম-লের ওজোন স্তর পাতলা করে দিচ্ছে। ফলে মানুষ, প্রাণী উদ্ভিদ জগতের শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে। এর প্রভাব বর্তমানে প্রকট না হলেও নিকট ভবিষ্যতে বায়ুম- করে তুলবে অনিরাপদ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হবে ত্বরান্বিত। অনতিবিলম্বে সেই মারাত্মক ঝুঁকি এড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদের।

বৈশ্বিক এই দূষণ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে না দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার এই আন্দোলনে আপনি-আমি, আমরা সকলেই এগিয়ে আসতে পারি। সম্মিলিত প্রচেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে ধরে রাখলে বৈশ্বিক আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ প্রয়োগ। সম্প্রতি (২২ থেকে ২৫ এপ্রিল, ২০২৪) বাংলাদেশে জাতিসংঘ জলবায়ু অভিযোজন সম্মেলনন্যাশনাল এ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ) এক্সপো ২০২৪অনুষ্ঠিত হলো। ন্যাপ এক্সপো একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম যেখানে বিভিন্ন দেশ, সংস্থা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা ন্যাপ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

এই এক্সপো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যাপ প্রণয়ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত গ্যাপ এবং চাহিদা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল কার্যক্রম হাতে নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের অভিযোজন কার্যক্রম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় থেকে সবাই পারস্পরিকভাবে উপকৃত হতে পারবেন। আপাতত সচেতন নাগরিকদের জলবায়ু পরিবর্তন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে সচেষ্ট হতে হবে। সর্বপ্রথম রাস্তা, বাঁধ, প্রাতিষ্ঠানিক গাছ কাটা বন্ধ করি। সাধারণত একটা চারা গাছ রোপণ করলে তা বড় হতে -১০ বছর সময় লাগেএমন একটা পরিপক্ব গাছ যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে, অনেক চারা গাছ তা পারবে না। তাই আদি গাছ অর্থাৎ মা গাছ রক্ষার পাশাপাশি অনেক গাছ রোপণ করতে হবে। গাছ যেমন পরিবেশ শীতল রাখে, তেমনি অর্থনৈতিক  সচ্ছলতাও দেয়।

অন্যদিকে কিছু নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন : বায়ুশক্তি, সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় না। তাই এগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। গাছ রোপণের ক্ষেত্রে স্থান ভেদে জাত নির্বাচন করা জরুরি। যেমন, রাস্তার দুই স্লোপে বা বাঁধে নিম, রেইন ট্রি, জারুল, কদম, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া। রাস্তার বিভাজক বা দুই লেনের রাস্তার মাঝে সোভা বর্ধনকারী গাছ দেবদারু, রাধাচূড়া, জবা, কনক চাঁপা, ক্রিসমাস ট্রি। খোলা জায়গা যেমন : সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুকুর পাড়, পশু-পাখির খামারে মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, অর্জুন, বট, কদম, চাপালিশ, অশোক, আম, কাঁঠাল, জারুল। বাড়ির আঙ্গিনা বা উদ্যানে ফল জাতীয় গাছ আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, বেলনারিকেল। ভেষজ উদ্ভিদ জলপাই, আমড়া, আমলকী, বহেরা, সজিনা, তুলসী, পুদিনা ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।

আমাদের দেশে আষাঢ়- শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল, আশা করা যায়  বৈশাখের বিদায়ে প্রকৃতি কাঁদবে অর্থাৎ বৃষ্টি নামবে। এটাই হচ্ছে গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমাদের সাধ্যমতো প্রত্যেকে বনজ, ফলদ ফুলের গাছ লাগাই। আর দেরি নয়, আগামী প্রজন্মের জন্য অক্সিজেন মজুত করার এখনই সময়। তাই সামাজিক বনায়ন গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে আসি, প্রকৃতিকে তার আপন রূপ ফিরিয়ে দেই, সবুজে সাজিয়ে তুলি।

লেখক : কৃষিবিদ

×