ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি

কোথাও ওঁৎ পেতে আছে দীর্ঘশ্বাস

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৪ মে ২০২৪

কোথাও ওঁৎ পেতে আছে দীর্ঘশ্বাস

কোথাও ওঁৎ পেতে আছে দীর্ঘশ্বাস

বিকেল। বাসে বসে আছি। সকালে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পাইনি। দেখলাম- সকালের মেট্রোর কয়েক কপি এখনো বাসে ঢোকার মুখের ক্যারিয়ারে পড়ে আছে। তারই একটা তুলে এনে দোতলায় উঠে ঝাঁকিয়ে বসেছি। মোটামুটি দীর্ঘ পথ। পত্রিকা পড়তে পড়তে কেটে যাওয়ার কথা। আজকের পত্রিকায় একটা ভয়াবহ খবর ছাপা হয়েছে। ইস্ট ল-নের এক জায়গায় এক যুবক বিশাল দৈর্ঘ্যরে সামুরাই তলোয়ার হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছে ভোর হওয়ার সামান্য পরে।

ঘরে ঘরে বাচ্চারা তখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, বড়রা নিজ নিজ কাজে। এমন সময় সাদা রঙের একটি ভ্যান হুড়মুড় করে এসে ধাক্কা লাগায় একটি বাড়ির দেওয়ালে। ঐ পথে থাকা এক পথচারী ঘটনা দেখে চালকের খোঁজখবর নিতে এগিয়ে যেতেই দেখেন, ভ্যানচালক তার দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে। ছত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক। হলুদ হুডি পরা। হাতে সামুরাই তলোয়ার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটি তলোয়ারের কোপ বসালো পথচারী ভদ্রলোকের গায়ে। ঘটনাটা পাশের বাড়ির কেউ দেখে তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোন করে।

এদিকে তলোয়ার হাতের যুবক রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এ বাড়ি ও বাড়ি ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। মুহূর্তেই পুরো এলাকায় ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চৌদ্দ বছরের এক বালক স্কুলে যাচ্ছিল। তাকে সামনে পেয়ে দ্বিতীয় কোনো কথা না বলেই বালকের গায়ে তলোয়ারের কোপ বসায় যুবকটি। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশ আসতেই সে পুলিশের দিকে তরবারি উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, এখানে কেউ আছে যে গডকে বিশ্বাস করে? এভাবে ঐ এলাকায় বেশ কিছুক্ষণ আতঙ্ক ছড়ানোর পর, অবশেষে পুলিশ সদস্যরা তাকে টিজার গান দিয়ে আহত করে এবং শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। চৌদ্দ বছরের ছেলেটি ঘটনাস্থলে মারা যায়।

এছাড়াও দুজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত চারজন মানুষ হলুদ হুডি পরা যুবকের তরবারির আঘাতে আহত হয়, তবে সৌভাগ্যক্রমে কারোর আঘাতই প্রাণঘাতী নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ জানাচ্ছে, ঘটনাটা সন্ত্রাসী আক্রমণ জাতীয় কিছু নয়। এটি একটি ‘বিচ্ছিন্ন ম্যানিয়াক’ ঘটনা।
বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পুরো খবরটি পড়লাম। চৌদ্দ বছরের ছেলেটির জন্য খুব মন খারাপ হলো। মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তায় আরেকবার ‘অভিভূত‘ হলাম। নিষ্পাপ একটা বালক। স্কুল যাচ্ছিল। বাসা থেকে স্কুল। কত দূরই বা হবে! নিশ্চয়ই বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা বলেছিল, ভালো থাকিস, বাবা। সাবধানে থাকিস, বাবা। ছেলে উত্তর দিয়েছিল, জি মা, চিন্তা করো না। হয়তো বলেছিল, আজকের বাসায় ফিরে মিনস-পাই খাব, মা। মা বলেছিল, পাগলা, ভালো করে পড়াশোনা করে আয়, খাওয়াবো। পত্রিকা লিখেছে, ছেলেটি খুব ফুটবল পাগল ছিল।

ছিল আর্সেনালের একনিষ্ঠ ভক্ত। নিজেও সে খুব ভালো ফুটবল খেলে। তার স্কুলের গেম টিচার বলেছে, এই ছেলেটির ফুটবলের ড্রিবলিং স্কিল খোদ মেসির চেয়েও ভালো। হয়তো সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে সে পরিকল্পনা করেছে, বিকেলে ফিরে এসে মাঠে একসঙ্গে খেলতে যাবে। তার নতুন শেখা ড্রিবলিং স্কিল দেখিয়ে বাবাকে তাক লাগিয়ে দেবে। এই শনিবারে আর্সেনাল বর্ণমাউথের সঙ্গে ফুটবল খেলবে। নিশ্চয় সেই খেলাটি নিয়ে ভেতরে ভেতরে সে খুব উত্তেজিত ছিল। আর্সেনাল জিতবে বলে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরেছিল।

কারও সঙ্গে একসঙ্গে খেলা দেখবে বলে রেখেছিল বিশেষ কোনো পরিকল্পনা। জীবনের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর একটি বাড়ন্ত প্রাণ কতরকম রঙিন কল্পনাতেই না মেতে ছিল সারাটিক্ষণ! অথচ, এর সবই এখন স্র্রেফ হতাশ দীর্ঘশ্বাস। একটি অমিত সম্ভাবনার প্রাণ ঝরে গেল একবারে কোনো কারণ ছাড়া, সবচেয়ে নিদারুণ অপচয়ে।
জেফরি আর্চার বিশ্ববিখ্যাত গল্পকার, ঔপন্যাসিক। জাতে ইংরেজ। অনেক বিশ্বজোড়া বেস্টসেলার বইয়ের এই লেখকের তিনটি গল্প-বইয়ের গল্পগুলো একসঙ্গে করে একটি খুব মোটা গল্পের সংকলন ছাপা হয়েছে। বইটির একদম শুরুতে, তার নিজের গল্প ছাপার আগে তিনি একটি খুব ছোট অনুবাদ গল্প ছেপেছেন। গল্পটি একটি আরবি গল্পের অনুবাদ। গল্পকারের নাম জানা যায় না।

ফলে ‘জনৈক আরবি লেখক’ পরিচয়ে এ গল্পটি নানান বর্ণনায় পাওয়া যায়। জেফরি আর্চারের কথায়, একজন গল্পকার হিসেবে তিনি এমন কোনো গল্প লেখার কেবল স্বপ্নই দেখতে পারেন। অল্পকথায় গল্পটি এরকম : একজন মুনিব। একজন ভৃত্য। ভৃত্য বাজারে গিয়েছে মুনিবের জন্য কিছু সওদা কিনতে। কিন্তু বাজারের চত্বরে এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। মানুষটি তাকে দেখে ভয়ংকর মুখভঙ্গি করে। ভৃত্য আঁতকে উঠে বুঝতে পারে, এ কোনো সাধারণ মানুষ নয়। এ হচ্ছে স্বয়ং মৃত্যু।

নিশ্চয় তার জান কবচ করতে এসেছে। আতংকিত ভৃত্য সওদা না নিয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে এসে মুনিবকে ঘটনাটা খুলে বলে। তারপর অনুরোধ করে যেন মুনিবের সবচেয়ে দ্রুতগতির ঘোড়াটি তাকে ধার দেয়। উদ্দেশ্য, খুব দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে সে আজ সন্ধ্যার মধ্যে পাশের শহরে পালিয়ে যাবে। ফলে, মৃত্যু আর তার দেখা পাবে না। সদাশয় মুনিব তাকে আস্তাবলের সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটি ধার দেয়। ঘোড়া পেয়ে জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তকর তাগিদে ভৃত্য ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় পাশের শহরের উদ্দেশে।

কিছুক্ষণ পর মুনিব নিজেই সওদা কেনার জন্য বাজারে যায়। গিয়ে তার সঙ্গে সেই মৃত্যুর দেখা হয়। মুনিব তাকে প্রশ্ন করে, তুমি আজ সকালে কেন আমার ভৃত্যকে দেখে অমন বিকট মুখভঙ্গি করলে? মৃত্যু উত্তর দেয়, বিকট মুখভঙ্গি করিনি তো! আমি তো ওকে আজ এই শহরে দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বোধহয় আমার মুখভঙ্গি বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কেননা, আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, হিসেব অনুযায়ী, আজ রাতে ওর সঙ্গে তো আমার পাশের শহরে দেখা হওয়ার কথা, ওখানেই তার প্রাণ বধ করার কথা। এ শহরে ও কী করছে?
অর্থাৎ খুব অল্পকথায় এ গল্পটি যে বার্তাটি আমাদের জানাতে চায়, তা হলো : মৃত্যু অমোঘ নিয়তি। একে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এর সবই সত্য। কিন্তু তারপরও যখন সামনে ঐ চৌদ্দ বছরের ছেলেটির মতো সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, সম্পূর্ণ অমানবিক মৃত্যুর ঘটনা শুনি, পড়িÑ কেমন সব এলোমেলো লাগে। ভয়ংকর কথাটি হচ্ছে, এমন ঘটনা কিন্তু হরহামেশা ঘটেই চলেছে।

আমেরিকায় তো প্রায়ই কেউ না কেউ বন্দুক হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে মানুষ মেরে ফেলছে। স্কুলের কোনো বাচ্চা বাপ-মায়ের বন্ধুক চুরি করে এনে ক্লাসরুম ভরা বন্ধুদের ওপর গুলি চালিয়ে দিচ্ছে। স্টিফেন কিংয়ের বিখ্যাত ডিটেকটিভ উপন্যাস মার্সিডিস কিলার। ২০১৪ সালে বইটি যখন বের হয়, একদম প্রথম সপ্তাহেই পড়ে ফেলেছিলাম। গল্পটি শুরু হয় এক ভয়ংকর ঘটনা দিয়ে। গরিব লোকজন ভোর থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাকরির জন্য।

লোকজনের সেই লাইনের ওপরেই, কোনো রকম কথা-বার্তা ছাড়া এক ভয়ংকর খুনি তার মার্সিডিস চালিয়ে দেয়। মুহূর্তে তৈরি হয় এক নারকীয় দৃশ্য। স্পষ্ট মনে আছে, বইটি পড়তে পড়তে কেন জানি মনে হচ্ছিল, এ ঘটনাটি যদি কোনো ভয়ংকর মানসিকতার খুনি নকল করে বাস্তবে ঘটানোর চেষ্টা করে! তখন জানতাম না যে বইটি প্রকাশ হওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এলিয়েট রজার নামক এক লোক তার এপার্টমেন্টে তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা করে, পার্কি স্পেসে গুলি করে হত্যা করে আরও তিনজনকে এবং তার বিএমডব্লিউ গাড়ি চালিয়ে দেয় রাস্তায় চলতে থাকা নিরীহ পথচারীদের ওপরে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের জীবনের ইতি টানে।

পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে বাসের জানালায় চোখ রেখে দেখলাম, দূরে, উঁচু উঁচু ইমারতগুলোর গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে সূর্য। গোলাপি হয়ে উঠছে তার রং। ওপরে দিগন্ত বিস্তারি নীল আকাশের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাদা মেঘে সেই গোলাপি আভা। কী সুন্দর যে লাগছে দৃশ্যটি! রাস্তার পাশের পার্কে ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ করে খেলছে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো নিজের অজান্তে। অপার সম্ভাবনাময় পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে এই নিষ্পাপ বাচ্চাকাচ্চাগুলোর জন্য। কিন্তু ওরা কি জানে, দিনে দিনে কী ভীষণ ‘ম্যানিয়াক কিলার’দের পৃথিবী তৈরি করেছি আমরা!
৪ মে ২০২৪

[email protected]

×