ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

রমজানের শিক্ষা ও শাওয়ালের ৬ রোজা

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

রমজানের শিক্ষা ও শাওয়ালের ৬ রোজা

প্রসঙ্গ ইসলাম

ফরযিয়াতের ওপর আমল করার সঙ্গে সঙ্গে নফল আমলের অভ্যাস গড়ে তোলা অতি জরুরী। রাসূলুল্লাহ (স.) নফল নামাজ ও নফল রোজার প্রতি বেশ উৎসাহিত করেছেন। এতে বহু ফজিলত রয়েছে। ফরজ আদায়ের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে নফলের দ্বারা তা পুরা করে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ আছে। সুতরাং ফরজ রোজার পাশাপাশি নফল রোজার প্রতি যতœ নেওয়াও বাঞ্ছনীয়।

অবশ্য বছরে ৫ দিন রোজা রাখা জায়েজ নয়। দুই ঈদের দিন এবং ঈদুল আযহার পর ১১, ১২ আর ১৩ই জিলহজ মোট এই পাঁচদিন রোজা রাখা হারাম। এই পাঁচদিন এবং রমজানের রোজা ছাড়া যে কোনো দিন নফল রোজা রাখা জায়েজ।- (ফাতাওয়া ও মাসাইল, ইফা ৪র্থ)। 
শাওয়ালের ৬ রোজা : মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা করে এবং এরপর গোটা শাওয়াল মাসের যে কোনো ৬ দিন রোজা রাখে, সে যেন সারা বছর রোজা রাখল। কেননা, বৎসর হয় তিন শত ষাট দিনে এবং রমজানের রোজা (স্বাভাবিকভাবে) ৩০ দিনে দশগুণ বৃদ্ধিতে) তিন শত দিন হয় আর বাকি থাকে ৬০ দিন। যদি শাওয়ালের ছয় রোজা রাখে দশগুণ বৃদ্ধিতে তা ষাট দিন সমতুল্য হলো।

সুতরাং ৬ রোজা দ্বারা গোটা বছরই পূর্ণ হলো। - (মজমুয়ায়ে খুতবায়ে রশীদিয়া-১৭৫)। এমনিতেই মাহে রমজানের যে অফুরন্ত অর্জন তা যেন ঈদের আনন্দের মাধ্যমে হারিয়ে না যায়। তাই আবার রোজার অভ্যাস রেখে সিয়াম সাধনার উপকারিতা আমাদের জীবনে কার্যকর করতে হবে। রমজানের পর আমরা ব্যাপকভাবে সিয়ামের শিক্ষার বিপরীতে চলতে থাকি। ফলে, শয়তানি কর্মকান্ডে আবার মনের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ি। এসব হীন কর্মকাণ্ডে অতীতের ভালো আমলগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।

যেমন আমরা রমজানের পর থেকে নানাভাবে কুফরি কাজ করি, শিরকি আচরণ করি, আখিরাতের ওপর, তাকদিরের ওপর পূর্ণ বিশ^াস লালনে অবহেলা করি। আল্লাহর বহু অসন্তুষ্টিমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ি সে চাঁদ রাত থেকেই। পাশের যে যুবকটি ইখলাসের সঙ্গে শেষ দিনের ইফতার করল ঈদের চাঁদ ওঠার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে উঠল বেপরোয়া। নামাজ রোজার পরিবর্তে সে গান বাজনা ও সভ্যতা বিবর্জিত আনন্দে মেতে উঠল। এতে তার আগের নেক আমলগুলো ক্রমে নষ্ট হয়ে যায়। (এর জন্য বিস্তারিত দেখুন সূরা মুহাম্মদ আয়াত ৮, ৯ ও ৩৩, সূরা মায়েদা ৫, সূরা আরাফ ৪৭)। 
উল্লেখ্য, শাওয়ালের এ ৬ রোজা গোটা মাসের যেকোনো দিনে রাখা যায়। আপনি একসঙ্গে রাখতে পারেন অথবা ভেঙে ভেঙে গোটা মাস রাখতে পারেন। দোষের কিছু নেই। তবে কোনো কারণে রমজানের রোজা যদি ভাঙা হয় তা আগে পূরণ করে দেওয়া উচিত। 
প্রসঙ্গত, বছরের অন্যান্য মাসে নফল রোজা রাখার ফযিলত: 
জিলহজ ও ইয়াওমে আরাফাহ : জিলহজ  মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের দশ তারিখে আমরা ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ আদায় করি। এ ছাড়াও এ মাসের প্রথম দশটি দিন মুমিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতের দিন, যে বিষয়ে আমরা অনেকেই সচেতন নই। বিভিন্ন সহীহ হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। সহীহ বুখারী ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন : 
দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ফজিলতের দিন হলো জিলহাজ মাসের প্রথম এ দশ দিন। হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৫৩ যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এই দশ দিনের সিয়াম এক বৎসরের সিয়ামের তুল্য এবং প্রত্যেক রাতের নামাজ লাইলাতুল কাদ্রের নামাযের তুল্য। (তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩১৩)।  

হুজুরে আকরাম (স.) বলেছেন, আমি আল্লাহ পাকের দরবারে আশা রাখি আরাফাহ দিবসে রোজা রাখলে তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। এ হলো বিশে^র সর্বত্র মুসলমানদের পালনীয় বিধান। হাজি সাহেবরাও এদিন সিয়াম পালন করতে পারেন। তবে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পাদনে দুর্বল হয়ে যাওয়া হাজির ওপর এ সিয়াম পালন মাকরুহ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।  - (ফাতাওয়া ও মাসাইল, ইফা ৪র্থ)।  
মুহরমের আশুরায় ৩ রোজা প্রসঙ্গ : প্রিয় নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আফজালুস সিয়াম বাদা রামাদানা শাহরুল্লহীল মুর্হরাম। অর্থাৎ রমজানের রোজার পর শ্রেষ্ঠ রোজা আল্লাহ তায়ালার মাস মুহরমের। তিনি আরও ফর্মায়েছেন, আমি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আশা রাখি ১০ই মুহরমের রোজা এর পূর্ববর্তী বছরের গুনাহর কাফ্ফারা হবে।-(মুসলিম)। তিনি আরও বলেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে রোজা রেখ এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণই কর। (তারা মাত্র ১ দিন রোজা রাখে তাই) তোমরা এর পূর্বের দিন ও পরের দিন রোজা রাখ।
শাবান ও শবে বরাত : বুখারী শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) শাবান মাসের চেয়ে অধিক নফল রোজা আর কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি প্রায়ই পুরো শাবান মাসই সাওম পালন করতেন।
আইয়ামে বীযের রোজা : চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের  দিনগুলোকে আইয়ামে বীয বলা হয়।

যে ব্যক্তি প্রতিমাসে এই তিনদিন রোজা রাখল সে যেন সারা বছর রোজা রাখল। নবী করিম (স.) সাধারণত প্রত্যেক মাসের এই তিনদিন রোজা রাখতেন। বুখারী শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (স.) আমাকে তিনটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন:
১. প্রতিমাসে তিন দিন রোজা রাখা।
২. দু’ রাকাত সালাতুদ দুহা আদায় করা।
৩. নিদ্রার পূর্বে বিতিরের নামাজ আদায় করা।
সোম, বৃহস্পতি ও জুমাবার : সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোজা রাখা মুস্তাহাব। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, সোমবার এবং বৃহস্পতিবার মানুষের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। অতএব, আমি পছন্দ করি যেন রোজা অবস্থায় আমার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। (মারাকিল ফালাহ)। কোনো কোনো বর্ণনায় এমনও আছে, সোমবার দিন আমি রোজা রাখি। কেননা, এদিন আমি দুনিয়াতে তাশরিফ এনেছি। এদিন আমার ওপর আল কুরআন নাজিল হয়েছে। এদিন আমি হিজরত করেছি আর এ দিনেই আমি ওফাতপ্রাপ্ত  হব। 
অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে জুমু’আর দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব ।- (আলমগীরী, ১ম খ-)।
রোজা রাখার নিষিদ্ধ দিনসমূহ : দুই ঈদের দিন এবং ঈদুল আজহার পর তিন দিন মোট পাঁচ দিন রোজা রাখা হারাম। রাসূল (স.) বলেছেন, এ দিনগুলোতে রোজা রাখবে না। কেননা এ হলো পানাহার এবং  সম্ভোগের দিন। কেউ যদি এ দিনগুলোতে রোজা রাখতে আরম্ভ করে ছেড়ে দেয়, তবে তার ওপর কাযা ওয়াজিব হবে না। (আলমগীরী ১ম খ-)।

লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×