ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ভোগের শেষ নেই চট্টগ্রামবাসীর

মেঘ দেখলে আতঙ্ক, বর্ষণ হলেই ঘটছে বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৬ জুন ২০১৭

মেঘ দেখলে আতঙ্ক, বর্ষণ হলেই ঘটছে বিপর্যয়

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নীল আকাশে মেঘ দেখলে অথবা গুমোট অবস্থা লক্ষ্যণীয় হলেই সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। আর মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হলেই নেমে আসে মারাত্মক বিপর্যয়। অবস্থা এমন হয়ে যায় যে, জলজটে একাকার হয়ে যায় গোটা শহর। আর এর জের হিসেবে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়ে যায় সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ী থেকে শিল্প কারখানা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এক অর্থেই দুর্ভোগের সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিতে একাকার হয়ে যায়। এ ঘটনা ও করুণ দৃশ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামের। এ নগরীর সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত এবং সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ। বাণিজ্য পাড়াগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করে শেষ করা যায় না। এর পাশাপাশি রয়েছে আবাসিক বাড়িঘর ও রাস্তায় চলাচলরত ছোট বড় যানবাহনেরও ক্ষতির বিষয়টি। আর ছোট বড় রাস্তার অবস্থা বেহাল হয়ে বছর বছর সরকারী কোষাগারের অর্থই পানিতে যাচ্ছে। একদা সত্যিকার অর্থে প্রাচ্যের রাণী বলা হতো এ চট্টগ্রামকে। এখন তা হয়েছে রূপকথার কাহিনীর মতো। কথাটি চালু আছে। তবে তা কাগজে কলমে। তথ্য অনুসন্ধানে এর নেপথ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বড় ছোট সব কটি খাল, উপখাল, আর অসংখ্য নালা বহু আগে ভরাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা। খালগুলোর দুই পাশ ঘিরে গড়ে উঠা বসতি এবং পাহাড়ি মাটি ও শহর থেকে অপসারিত বর্জ্যে ঘিলে খেয়েছে খাল ও উপখালগুলো। সর্বত্র গড়ে উঠেছে বসতি ও দোকানপাট। হয়ে গেছে ঘিঞ্জি পরিবেশ। প্রতিনিয়ত মানুষ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বসতি এলাকাও। নগরায়নের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো বড় বড় প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। এসব প্রকল্প ভবিষ্যতের জন্য সুফলের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে বলে সুনির্দিষ্টভাবে চিল্লাহল্লা করে যাচ্ছে নগর পরিকল্পনাবিদগণ। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে কার কথা কে শুনে। অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টিকে প্রাধান্য না দিয়ে বড় বড় প্রকল্প তথা ফ্লাইওভার, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদি জাতীয় প্রকল্পের ইতিবাচক দিকের চাইতে নেতিবাচক মতামত রয়েছে বেশি। বর্তমান গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নগরীতে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারকে ওভারপাস উল্লেখ করে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিন্তু পরে এ নিয়ে তিনি আর মুখ খুলেননি। কেন খুলেননি তা অজ্ঞাত রয়েছে। চাক্তাই খালসহ নগরীর বুক চিরে প্রবাহিত অপরাপর খালের তলা পাকাকরণ, মাটি ও বর্জ্য উত্তোলনের নামে বছর বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে কি সফলতা এসেছে তা কারও অজানা নয়। কিন্তু কেন এ ধরনের প্রকল্প নেয়া হলো তার কোন উত্তর নেই। চলতি বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকেই এ নগরীতে সামান্য বৃষ্টিতেই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা নজিরবিহীন। আগে বৃষ্টির পানিতে নিম্নাঞ্চলে জলজট হতো। এখন সমতল এলাকাও বাদ যাচ্ছে না। এ নগরে একটি মাত্র বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদেরও কপাল পুড়েছে। পাশাপাশি আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এ আবাসিক এলাকার লোকজন প্রতিনিয়ত বাড়ি ছাড়ছেন। কারণ বর্ষণ হলেই শুধু রাস্তাঘাট নয়, ভবনগুলোর নিচ তলাও পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বিশাল এ সিডিএ আবাসিক এলাকার ভবনগুলোর এমন কোন নিচ তলা নেই যেখানে বর্ষণের পানিতে সয়লাব হচ্ছে না। এ এলাকায় সরকারী দফতর থেকে স্কুল, কলেজও রয়েছে। সকলেরই দশা অতি করুণ। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র বার বার বলে আসছেন এ করুণ পরিণতি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে নগরবাসীর প্রতি তার আন্তরিক মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু জলাবদ্ধতার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি যে প্রকল্প পেশ করেছেন তা কবে নাগাদ অনুমোদন পাবে এবং তা কবে থেকে কার্যকর হবে তা এখনও সুনির্দিষ্ট নয়। তাই সত্যিকার অর্থেই নগরবাসীকে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষাই করে যেতে হবে। এদিকে, আগামীতে এ নগরীতে টানেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এ টানেল নির্মিত হলে কর্ণফুলীর দক্ষিণ ও উত্তর পাড়ের সংযোগ ঘটবে। রূপ নেবে টুইনসিটি’র। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছে চট্টগ্রাম হবে সাংহাই, সিঙ্গাপুর ইত্যাদিসহ নানা নামে। আবার গ্রীনসিটিতে পরিণত করার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে মেয়রের। এসব ঘোষণা আদৌ বাস্তবায়িত হবে না কথার কথায় থেকে যাবে তাই নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র একটি অংশের রাস্তাঘাট ও কালভার্টের দুরাবস্থা দেখে খোদ প্রধানমন্ত্রী মারাত্মক ক্ষোভ প্রকাশ করে গেছেন। টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কোথায় এমন প্রশ্নও করে গেছেন। বলে গেছেন ২০১৫ সালে তিনি এ অবস্থা দেখে গেছেন ২০১৭ সালেও সে অবস্থায় পরিবর্তন এলো না কেন? তিনি আরও জানান দিয়েছেন, বড় বড় প্রকল্প পাস হয় একনেক সভায়। সে সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। সুতরাং তিনি অবহিত আছেন কোথায় কি প্রকল্প নিয়ে কি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। তিনি হুঁশিয়ার দিয়ে বলে গেছেন, কমিশনবাজি চলবে না। সাবধান করে গেছেন আগামীতে চট্টগ্রামে এলে তিনি যেন এ অবস্থা আর না দেখেন। এটি হচ্ছে পতেঙ্গার ক্ষুদ্র একটি এলাকার। নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি অনুষ্ঠানে এসে ওই এলাকার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে ক্ষেপে যান। এ ঘটনার পর ওই এলাকার কালভার্টও রাস্তা সংস্কারে গতি এসেছে। কারণ সরকার প্রধান আল্টিমেটাম দিয়ে গেছেন। কাজ না হলে খবর আছে। তাই তড়িঘড়ি করে চলছে কাজে। বিষয়টি শুধু পতেঙ্গার ওই ক্ষুদ্র একটি এলাকার। কিন্তু সরকার প্রধান দেখেননি গোটা চট্টগ্রামের বাস্তব চিত্র। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, আবাসিক এলাকা, জিইসি মোড়, প্রবত্তক মোড়, মুরাদপুর, ষোলশহর, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, চান্দগাঁও, বৃহত্তর বাকলিয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা অল্প বৃষ্টিতেই অথৈই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ উপকূলে আঘাত হানার পর যে ভারি বর্ষণ হয়েছে তাতে যে পরিমাণ উচ্চতার পানি শহরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে তা ছিল নজিরবিহীন। মোরা’র প্রভাবে সর্বশেষ রবি ও সোমবারও বৃষ্টি হয়েছে। যখনই বৃষ্টি তখনই জলজট। এ যেন অসহনীয় এক দুর্দশা। যারা বাড়িঘর নির্মাণ করে ফেলেছেন তারা যাবেন কোথায়। ভাড়াটিয়ারা ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যাচ্ছেন। বড় ছোট সব ধরনের রাস্তায় অথৈই পানি জমে যায়। যানবাহন তলিয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় ইঞ্জিনসহ নানা যন্ত্রপাতি। স্বাভাবিক জীবন চলার পথে নেমে আসে অস্বাভাবিকতা। এ থেকে কোন উত্তরণ পাওয়ার পথ দৃশ্যমান নয়। তবে আশার বাণীর কমতি নেই। কিন্তু বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। ঘূর্ণিঝড় হলে চট্টগ্রাম উপকূলকে আঘাত করে থাকে। জলোচ্ছ্বাসও হয়। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে প্লাবণ সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা আগে হতো না। এখন হচ্ছে। প্লাবণে গিলে ফেলে এ শহরকে। নগরীতে ৪১টি ওয়ার্ড এমন কোন ওয়ার্ড অবশিষ্ট নেই যেখানে ভারি বর্ষণে সৃষ্ট জলজটের ঘটনা ঘটছে না। রক্ষা পাচ্ছে না কেউই। জলজট সমস্যা নিরসনে সরকার প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে কম বেশি। কিন্তু বরাদ্দের বড় একটি অংশ লোপাট হয়ে যায়। আর ক্ষুদ্র অংশটি দিয়ে যে কাজ হয় বিপরীতের ব্যয়িত অর্থ চলে যায় পানিতে। গেল কয়েক বছর ধরে এ নগরীর এমন হতশ্রী রূপ নিয়েছে যা অতীতের অবস্থার বিপরীত। বনায়ন ও সবুজের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অতীতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও লাভ করেছেন। এখন হতশ্রী নগরীর জন্য যদি প্রতিযোগিতায় নাম আসে তাহলে তাতে নিশ্চয় চট্টগ্রামের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে বলে জানাচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকার নানা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামকেই বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন দুটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। বিদেশীদের আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে মূল শহর এলাকাটি যদি পানি আর পানিতে ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে থাকে তাহলে বিদেশী বিনিয়োগও বিনিয়োগকারীদের চিন্তা ভাবনায় কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। যে চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহিনী শিরা হিসেবে চিহ্নিত। অথচ এ বন্দরের অভ্যন্তরীণ অবস্থায় অপচয় অনিয়ম দুর্নীতির কমতি নেই। অতীতে এ ধরনের ঘটনায় ঘটেছে সীমাহীন। বর্তমানে এর ধকল সামলাতে হচ্ছে বর্তমান প্রশাসনকে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট পুরো বন্দরকে গ্রাস করে রেখেছে। প্রতিবছর আমদানি-রফতানির কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু জাহাজ বার্থিংয়ের প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে সুবিধাভোগীরা। এসব সুবিধাভোগীরা বিশেষভাবে সুবিধা নিয়ে সরকারী অর্থপ্রাপ্তির ক্ষতিও করছে। এদের খবরদারিতে বন্দর প্রশাসনে অতিষ্ট পরিস্থিতি বিরাজমান। কিন্তু সবকিছুই যেন গুমোট হয়ে আছে। সরকার যখন প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা কার্যকরের জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে ডিজিটাল লোপাটের ঘটনাও ঘটছে বলে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এ বন্দরের হৃদপি- বলে পরিচিত কর্ণফুলী নদী। এ নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ১৬৫ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। কিন্তু এ জন্য শাস্তির আওতায় কেউ এসেছে এমন দৃষ্টান্ত এখনও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম বর্তমানে বৃষ্টিই প্রধান আতঙ্ক। জলজটই বিপর্যয়ের মূল কারণ। যাতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য থমকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিয়ত অচলাবস্থার কবলে পড়ছে। এসবের উত্তরণের সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উঠেছে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মহল থেকে।
×