ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চোরাইপথে প্রতিদিন আসছে ৩০ লাখ পিস, যার মূল্য ৯০ কোটি টাকা;###;মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৩৭ কারখানায় তৈরি হচ্ছে

ইয়াবার ঘোরে ৫০ লাখ

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ইয়াবার ঘোরে ৫০ লাখ

শংকর কুমার দে ॥ প্রাণঘাতী নীল নেশার মাদক ইয়াবার চোরাচালান আসা যেন কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দেশের শহর, নগর, বন্দর, গ্র্রাম-গঞ্জের সর্বত্রই গিলে খাচ্ছে মরণ নেশার ছোবল ইয়াবা। সারাদেশে এই মাদকে আসক্ত তরুণ-যুবকের সংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক। প্রতিদিন দেশে চোরাই পথে প্রবেশ করছে ৩০ লাখ পিস ইয়াবা, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৯০ কোটি টাকা। প্রতি মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা ৩৭ ইয়াবা কারখানা থেকে গড়ে প্রতিদিনই ৩০ লাখ পিস ইয়াবা নিয়ে আসছে চোরাকারবারীরা। সিল্ক রুটের হেরোইনের নামের আড়ালে ইয়াবা পাচারের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বের অন্যতম মাদক ট্রানজিটে পরিণত হবে বাংলাদেশ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণঘাতী মাদক ইয়াবার চোরাচালান থামাতে এখন রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, ইয়াবার থাবা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তৎপরতা যেমন বাড়ছে তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাচারকারীদের কলাকৌশল। গরুর পেটে অপারেশন করে মাদক রেখে পাচারের ঘটনা ঘটেছে অতীতে। এখন স্কচটেপ পেঁচানো ইয়াবা কলার মধ্যে ঢুকিয়ে সে কলা গিলে খাচ্ছে পাচারকারী দলের সদস্যরা। তারপর সীমান্ত থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাচার করে নিয়ে আসছে তারা। এই ধরনের কৌশলে সম্প্রতি দুই নারী তাদের পেটে এক হাজার ৮৫০টি ইয়াবা নিয়ে টেকনাফ থেকে ঢাকায় আনার পর ধরা পড়েছে। দুই নারীকে গ্রেফতারের পর দুই দিন ধরে হাসপাতালে রেখে নানা কসরতে পায়খানার সঙ্গে ৭৪টি ইয়াবার প্যাকেট বের করে আনতে সক্ষম হন তদন্তকারীরা। গ্রেফতার হওয়া দুই নারী আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বলেছেন, ইয়াবার চালান আনার জন্য তাদের পাঁচ হাজার টাকা দেয়ার কথা ছিল। অভাবের সংসারে বাধ্য হয়ে পেটের মধ্যে করে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন তারা। কিন্তু ধরা পড়ায় সব শেষ হয়ে গেল। রাজধানীর মতিঝিল থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল এলাকার শতাব্দী টাওয়ারের সামনে থেকে দুই নারীকে গ্রেফতার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পরে এক্স-রে করানো হলে এ দুজনের পেটে ইয়াবা থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সহায়তায় দুই দিনে ওই দুই নারীর পায়খানার সঙ্গে ৭৪টি ইয়াবার প্যাকেট বের হয়। প্যাকেট থেকে সর্বমোট এক হাজার ৮৫০টি ইয়াবা জব্দ করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ইয়াবার আগ্রাসন প্রতিদিনই বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নজরদারি এড়িয়ে প্রতিদিনই চলছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার। কুরিয়ার সার্ভিস, মাছসহ নিত্যপণ্যের চালানের ভিতর মাদক লুকিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে পাঠানো হচ্ছে। মাদক পাচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যে যথেষ্ট নয়, তার প্রমাণ দিচ্ছে প্রতিদিনের বিরাট অঙ্কের টাকার ইয়াবার চালান আসার ঘটনা। পারিবারিক অশান্তি, দারিদ্র্য, প্রেমে ব্যর্থতা, বেকারত্ব ইত্যাদি নানা কারণ তরুণ ও যুবসমাজকে মাদকাসক্তির দিকে নিয়ে যায়। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এবং এর মাধ্যমে মাদকের সহজলভ্যতা একটি বড় আশঙ্কার কারণ। বিশেষ করে অভিজাত এলাকার ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ইয়াবার জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী। তবে ফুটপাতের টোকাই থেকে ধনাঢ্য পরিবারে সন্তানদের মধ্যে ইয়াবার ছোবল ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গেছে। এজন্য প্রতিটি পরিবার ও সরকারকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হয়। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মহিলাদের গোপনাঙ্গে এবং শিশুদের মলদ্বারে বিশেষ পদ্ধতিতে পনেরো শ’ থেকে দুই হাজার ইয়াবা পাচার করা হয়। এর ৯০ শতাংশ ইয়াবাই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আমদানি করা গাছের মধ্যে খোড়ল কেটে ও মাছের প্যাকেটের মধ্যে ইয়াবা আনা হয়। তবে গডফাদাররা এখন সরাসরি বস্তাবন্দি অবস্থায়ই ইয়াবা আনা শুরু করেছেন। ইয়াবার চাহিদা দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাচার হয়ে আসা মাদকের মধ্যে বেশি আসছে ইয়াবা, তারপর আসছে ফেন্সিডিল ও হেরোইন। তবে এ সব মাদকের কোনটিই দেশের ভিতর উৎপাদন হয় না। এগুলো আনতে গিয়ে নিঃসন্দেহে দুর্বৃত্তরা দেশের বাইরে পাচার করছে বিপুল অঙ্কের টাকা। তিনি বলেন, ইয়াবাসহ অন্য মাদকদ্রব্য যে পরিমাণে পাচার হয়ে আসছে তার মাত্র ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ ধরা পড়ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। বাদবাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ চালান নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। দেশের ভেতরেও ইয়াবার চাহিদা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইয়াবা মাদকের যে বিশাল বাজার বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে তার রুট নিয়ন্ত্রণের জন্য এরই মধ্যে পাচারকারীদের মধ্যে শক্তি সঞ্চারের প্রতিযোগিতা শুরু হয় আর এ কারণে মাঝে মাঝেই প্রকাশ্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। কক্সবাজারের এই ইয়াবা ব্যবসা যেসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের যোগাযোগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক এক মাফিয়া চক্রের সঙ্গে। এই মাফিয়া চক্র টেকনাফের গডফাদারদের মাধ্যমে ইয়াবা সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর অনেক দেশে। আর এই মাদক চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরসহ দেশের সকল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে এই গডফাদারদের যোগাযোগ। কিছুদিন আগে টেকনাফের বিতর্কিত রাজনৈতিক এক নেতা দুই তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে। প্রশাসনের প্রায় সব বিভাগেরই অসৎ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আবার অনেকেই অনেকটা বাধ্য হয়ে জড়িয়ে পড়েছেন এই সর্বনাশা ব্যবসার সঙ্গে। অনেক কর্মকর্তা আবার ইয়াবাসহ ধরাও পড়ছে। এক এক বিভাগ এক এক বিভাগকে এ ব্যবসায় সহায়তা করছে। আর এই সহায়তায় মিলছে কোটি কোটি টাকার বিলাসী জীবন ও স্থাবর সম্পদ। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মরণ নেশা ইয়াবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এই বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’টি বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত অপরাধী চক্রর কর্মকা-ে উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের অবনতি হওয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গা যুক্ত হওয়ায় কক্সবাজার এলাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল অপরাধী কর্মকা-ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে আরও বলা হয়, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা কেবল বাংলাদেশই নয়, মাফিয়াদের হাত ঘুরে এখন ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সম্মান ক্ষুণœœ হওয়া ও ভাবমূর্তি সংকটের ঝুঁকি বাড়ছে। রাজধানীতে ছয় ইয়াবা বিক্রেতা গ্রেফতার ॥ ওরা ইয়াবা বিক্রেতা। তাই বেনামে মোবাইল ফোনের সিম সংগ্রহ করেছে। সেই সিম দিয়ে নিয়মিত ইয়াবা নিয়ে কথা হত কক্সবাজারে। চালান আসত এক ফোনের কলে। সেই চালান বিক্রি হত আবার অন্য ফোনের কলে। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা করত তারা ছয় বন্ধু। রাতারাতি বড় লোক হওয়া বা বিপুল বিত্তের মালিক হবার সহজ উপায় ইয়াবা বিক্রি। তাদের ভাষায়- কাঁচা বিনিয়োগে পাকা ফল। রাজধানীর জোয়ার সাহারা থেকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য প্রকাশ করেছে এই ছয়জন। তারা হলো- চায়না, সানি, ইনরান, রজব, শাহ জামাল ও ফাহাদ। ঢাকা মহানগর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উত্তর সার্কেলের পরিদর্শক কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে এক সাঁড়াশি অভিযানে ১৬৪/১. জোয়ার সাহারা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের আস্তানা থেকে ৫০০ ইয়াবা ও ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। কামরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা পেশাদার ইয়াবা বিক্রেতা। তারা কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান এনে রাজধানীতে হোম ডেলিভারি সার্ভিস দিত। বিশেষ কৌশলে তারা এগুলো বিক্রি করত। এমন তথ্য হাতে নিয়েই তাদের আটক করা হয়।
×