ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আশা জাগিয়েও হতাশার হার বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

আশা জাগিয়েও হতাশার হার বাংলাদেশের

মোঃ মামুন রশীদ ॥ শঙ্কাটা হানা দিয়েছিল ম্যাচের চতুর্থদিনেই। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৬ রানে ৩ উইকেট হারানো এবং দুই অপরিহার্য ব্যাটসম্যানের ইনজুরি দুশ্চিন্তার কারণ। সেটা সত্য হয়েছে, ৭ উইকেটের হার দেখেছে বাংলাদেশ দল। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে প্রথম টেস্টের পঞ্চম ও শেষদিনে মাত্র ১৬০ রানেই গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। মাত্র ২১৭ রানের জয়ের লক্ষ্য ছুঁয়েছে কিউইরা অধিনায়ক উইলিয়ামসনের ঝড়োগতির অপরাজেয় সেঞ্চুরির সুবাদে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে। প্রথম ইনিংসে এত বেশি রান করে জেতেনি আর কেউ। ১৮৯৪ সালে ৫৮৬ রান করেও ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ ৫৯৫ রান করেও পরাজিত হয়ে সেই লজ্জার নতুন রেকর্ড গড়েছে। ঘটনাবহুল এ টেস্টে ওপেনার ইমরুল কায়েস ও মুশফিকুর রহীমের ইনজুরিটাই ছিল সবচেয়ে আলোচিত। সে কারণেই পরাজয়ের ডঙ্কাটা বেজে উঠেছিল চতুর্থ দিন পর। অথচ সেদিন চা বিরতির আগ পর্যন্ত টেস্টের নিয়ন্ত্রণে ছিল বাংলাদেশই। চতুর্থ দিন চা বিরতির আধাঘণ্টা পরই ৫৩৯ রানে নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও ৫৬ রানে এগিয়ে বেশ ভাল অবস্থানেই থাকে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রান পর্যন্ত নির্বিঘেœ কেটে যায়, লিডও বড় হতে থাকে তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসের ব্যাটে। কিন্তু ইমরুলের বাম কোমরে টান লাগায় স্ট্রেচারে করে মাঠ ত্যাগ করার সঙ্গে যেন সব ভাগ্যকেও সঙ্গে করে নিয়েছিলেন। পরের ২০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ঘোর অন্ধকারের মুখোমুখি পড়ে যায় বাংলাদেশ দল। পঞ্চম দিন ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। মুমিনুল হক অপরাজিত ছিলেন, ডাবল সেঞ্চুরিয়ান সাকিব আল হাসান নামবেন। দায়িত্বটা তাদের কাঁধেই। কারণ বড় দুশ্চিন্তা ছিল মিডলঅর্ডার ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকের ডান হাতের দুই আঙ্গুলে প্রচ- ব্যথা, ইমরুলের কোমরে ব্যথা। তবে দায়িত্বটা নিতে পারলেন না মুমিনুল কিংবা সাকিব। দিনের অষ্টম বলেই মিচেল স্যান্টনারের বলে ক্যাচ দিয়ে শূন্য হাতে সাজঘরে ফিরলেন সাকিব। প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে ফিরে যাওয়া প্রথম বাঁহাতি ব্যাটসম্যান তিনি। তবে এমনটা টেস্ট ইতিহাসে আরও ৭ বার ঘটেছে। বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি মুমিনুলও। আর ১৩ রান যোগ করতে পেরেছেন নিজের নামের সঙ্গে। ব্যক্তিগত ২৩ রানে সাজঘরে ফেরেন পেসার নিল ওয়াগনারের বলে। দ্রুত দুটি অপরিহার্য উইকেট হারিয়ে বড় বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ দল। এরপর হাতের ব্যথা নিয়েই মাঠে নামেন মুশফিক। বেশ ভালভাবেই খেলছিলেন তিনি। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ইনিংসের ৪৩তম ওভারে। রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিংয়ে এসে শর্ট অব লেন্থের বল দিয়েছিলেন টিম সাউদি। কিন্তু সেটা বুঝতে পারেননি মুশফিক। শেষ মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে নিলেও তা হেলমেটের পেছনে মাথায় আঘাত করলে লুটিয়ে পড়েন। পরবর্তীতে মাঠেই কিছুক্ষণ চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হয়। ১৩ রান করেছিলেন তিনি। এরপর তাসকিন ফিরে দীর্ঘক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন সাব্বিরকে। শক্তহাতে হাল ধরে বেশ দারুণ খেলছিলেন তাসকিন। কিন্তু ২৩ বল ও ৫ রানের বেশি টিকতে পারেননি। কামরুল ইসলাম রাব্বিও সঙ্গ দিতে পারেননি সাব্বিরকে। তবে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ও টানা দুই ইনিংসে অর্ধশতক পেয়ে যান তিনি। ১০১ বলে ৯ চারে ৫০ রান করার পরই অবশ্য বিদায় নিয়েছেন পেসার ট্রেন্ট বোল্টের বলে। এরপর যেন বাধ্য হয়েই ইমরুলকে নামতে হয়েছে। তবে নামার পর বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ব্যাট চালাচ্ছিলেন ইমরুল। তাকে যথাসম্ভব সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন নবাগত শুভাশিষ রায়। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ টেকেনি। শুভাশিষ সাজঘরে ফিরে গেছেন কোন রান না করেই। ইমরুল ৩৬ রান করে অপরাজিত থাকেন। বাংলাদেশের ইনিংস তখনও শেষ হয়নি। কারণ অধিনায়ক মুশফিক আউট হননি। তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়েই বলছিলেন আবারও ব্যাটিংয়ে নামতে চান। সেটা আর হয়নি। ১৬০ রানেই গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশ দল। সাউদি তিনটি এবং ওয়াগনার ও স্যান্টনার দুটি করে উইকেট নিয়েছেন। ৯ উইকেট হারিয়েও অলআউট বাংলাদেশ স্বাগতিকদের জন্য জয়ের লক্ষ্য দেয় ২১৭ রানের। টেস্ট ক্রিকেট বিধায় সেটাকে খুব সহজ মনে হচ্ছিল না। বাংলাদেশের বোলাররাও দারুণ শুরু করেছিলেন। দলীয় ৩৯ রানেই দুই ওপেনার- জিত র‌্যাভাল (১৩) ও প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান টম লাথাম (১৬) সাজঘরে ফেরেন মেহেদি হাসান মিরাজের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। তবে এই মিরাজই পরে হতাশার নাম হয়ে গেছেন। তাকে তুলাধোনো করেছেন উইলিয়ামসন। আর নিয়মিত উইকেটরক্ষক মুশফিকের বদলি ইমরুলও ইনজুরিতে। তাই উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছেন সাব্বির। এ কারণে অতিরিক্ত রানটাও হয়েছে অনেক বেশি। তাসকিন ও মিরাজের ওপর তা-ব চালিয়েছেন উইলিয়ামসন ও রস টেইলর। তৃতীয় উইকেটে ওয়ানডে মেজাজে ব্যাট চালিয়েছেন তারা। ১৬৩ রানের জুটি হয় মাত্র ১৫২ বল থেকে। আর এতে করেই হার একেবারে নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। টেইলর ৭৭ বলে ৬ চারে ৬০ রান করার পর বিদায় নেন শুভাশিষের বলে। কিন্তু উইলিয়ামসন থামেননি। ক্যারিয়ারের ১৫তম সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। ৯০ বলে ১৫ চারে অপরাজিত ১০৪ রান করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন। মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ২১৭ রান তুলে এ জয় ছিনিয়ে নেয় নিউজিল্যান্ড। যেখানে জয় কিংবা ড্র ছাড়া অন্য কিছু চিন্ত্যনীয় ছিল না, সেই ম্যাচে নানাবিধ ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজয়ের তিলকটা বাংলাদেশের কপালেই জুটল। প্রথম ইনিংসে বিশাল সংগ্রহের পর দ্বিতীয় ইনিংসে বিপর্যস্ত হওয়ার ঘটনা টেস্ট ক্রিকেটে চিরাচরিত নিয়মের মতো। তবে এত রান করে হারের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো টেস্ট ইতিহাসে। ১৮৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার গড়া রেকর্ডটা ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই টেস্ট অবশ্য ৭ দিন ধরে হয়েছিল। বর্তমান নিয়মের টেস্টে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের দখলে র্ছিল এ লজ্জার রেকর্ড। মেলবোর্নে প্রথম ইনিংসে ৫৭৪ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেছিল তারা। কিন্তু পরে সেই ম্যাচে ৯২ রানে হেরে যায় দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০ রানেই থমকে গিয়ে। আবার ৫ দিনের টেস্ট ম্যাচে এমন পরাজয়ের লজ্জা আছে অস্ট্রেলিয়ারও। মাত্র ১৩ বছর আগে ২০০৩ সালে এ্যাডিলেইডে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৫৫৬ রান করেছিল তারা। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৯৬ রানে গুটিয়ে গিয়ে ৪ উইকেটের পরাজয় দেখেছিল তারা। ওয়েলিংটন টেস্টে সেই ইতিহাসগুলো চাপ পড়ল। ম্যাচের প্রথম দিনেই বৃষ্টির উৎপাত ছিল। ছিল তীব্র বাতাস ও কনকনে শীতের প্রকোপ। এর মাঝেও অচেনা পরিবেশে নিয়ন্ত্রণটা বাংলাদেশের হাতে ছিল চারদিন। তবে ইনজুরি আর ভাগ্য দুটোই বিরূপ হলো- আক্ষেপের হার সঙ্গী হলো মুশফিকদের।
×