ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

তেভেজের সংগ্রাম-সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

তেভেজের সংগ্রাম-সাফল্য

গল্পটা রূপকথাকেও যেন হার মানিয়ে যায়। মনে হতে পারে কোন নাটক-সিনেমার গালগল্প! কিন্তু গল্পের নায়ক বাস্তব হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। এখনকার কার্লোস তেভেজকে দেখলে বোঝাই যাবে না তার বাল্যকাল দারিদ্র্যের কষাঘাতে ছিল ক্লিষ্ট। ফুটবল খেলার জন্য বুট কেনার চিন্তা দূরের কথা, খাওয়াটাই জুটত না ঠিকমতো। অথচ আর্জেন্টাইন এ স্ট্রাইকার এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামী ফুটবলার। বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলার হয়ে গেছেন তেভেজ। চাইনিজ ক্লাব সাংহাই শিনহুয়া এ বছর তাকে কিনেছে বার্ষিক ৩৮ মিলিয়ন ইউরো মূল্যে। পারিশ্রমিকের দিক থেকে তেভেজের পেছনে এখন ব্রাজিলিয়ান তারকা অস্কার (২৪ মিলিয়ন ইউরো), ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (২৩.৬ মিলিয়ন ইউরো), লিওনেল মেসি (২০ মিলিয়ন ইউরো) ও হাল্ক (২০ মিলিয়ন ইউরো)। অথচ আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসের এক কুখ্যাত এলাকা ফোর্ট এ্যাপাচির ভয়ঙ্করতম রাস্তার পাশে এক বস্তিতে বেড়ে উঠেছেন তেভেজ! ছিল না এমনকি এক জোড়া বুট কেনার সামর্থ্য, মা ছিলেন মদ্যপ- বাবার ছিল না কোন খবর। বর্ণহীন শৈশব কাটানো সেই তেভেজের জীবনের রং পাল্টে এখন বর্ণিল। এখন সেই তেভেজের জীবনটাই সবচেয়ে রঙ্গিন, ৩২ বছর বয়সী তেভেজ ধনকুবের এক ফুটবলার। গল্পটা বেশ চমকে ভরপুর। নাটকীয় সেই গল্পটা শোনা যাক- চীনা ক্লাব শিনহুয়ার প্রস্তাবিত অর্থে সপ্তাহে কার্লোস তেভেজের পারিশ্রমিক দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড। বার্ষিক হিসাবে তা ৩১.৯৮ মিলিয়ন পাউন্ড। বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে দামী যে ১০ ফুটবলারের তালিকা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সেখানে তিন ও চার নম্বরে অবস্থান যথাক্রমে রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগীজ ফরোয়ার্ড রোনাল্ডো এবং তেভেজেরই স্বদেশী বার্সিলেনার সুপারস্টার মেসির। দুইয়ে জায়গা করে নিয়েছেন আরেক ব্রাজিলিয়ান বিস্ময় অস্কার। প্রিমিয়ার লীগের জায়ান্ট ক্লাব চেলসি ছেড়ে অস্কারও পথ ধরেছেন চীনের। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অস্কারের সবচেয়ে দামী ফুটবলার হওয়ার বিষয়টিই ছিল আলোচনার শীর্ষে। কিন্তু এবার অস্কারকেও সরিয়ে সবার ওপরে তেভেজ। অস্কারকে বার্ষিক ২০.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে দলে ভিড়িয়েছে চাইনিজ সুপার লীগের আরেক ক্লাব সাংহাই এসআইপিজি। রোনাল্ডো, মেসির পর ষষ্ঠস্থানে সাংহাই এসআইপিজির ব্রাজিলিয়ান তারকা হাল্ক। যার বার্ষিক আয় ১৬.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। তারপর রয়েছেন গ্যারেথ বেল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পল পোগবা, ব্রাজিলিয়ান সেনসেশন নেইমার, গ্র্যাজিয়ানো পেল্লে এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইংলিশ স্ট্রাইকার ওয়েন রুনি। এতসব বিশ্ব তারকাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ও আকর্ষণীয় বেতনের খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন তেভেজ। তেভেজ নিজেও হয়ত ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারেননি এভাবে পাল্টে যাবে তার জীবনযাত্রা। নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য আর ফুটবল শৈলিতে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছেন। তবে আরও অনেক তারকার ভিড়ে (বিশেষ করে মেসি-রোনাল্ডো-নেইমার-সুয়ারেজ) যেন কমই আলোকিত ও আলোচিত হয়েছেন তেভেজ। অথচ বাবা-মা পরিত্যক্ত করেছিলেন তেভেজকে। তার চাচা সেগুনডো তেভেজ তাকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। যখন ‘বাবা’ ডাকতে শুরু করেছিলেন, তখন চাচাকেই সেটা ডেকেছেন তেভেজ। যে পরিবেশে প্রতিবেশীরা রক্তক্ষয়ী মারামারি, ঝগড়া, ফ্যাসাদে প্রতিটা দিন পার করত, যে রাস্তায় প্রতিদিন ছিল সন্ত্রাসী আর অপরাধের কর্মকা-ে ভরপুর- সেখান থেকেই ফুটবলার হয়ে বের হয়ে এসেছেন তেভেজ। এমন একটি ঘটনায় সবচেয়ে বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও গুলি খেয়ে মরতে দেখেছেন দিন-দুপুরে শহরটির এক ক্যাসিনোয় সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধ চলার সময়। সেগুন্ডোর ইচ্ছাতেই জীবন পাল্টে যাওয়ার রাস্তা পেয়ে গেছেন তেভেজ। ১৯৮৯ সালের নবেম্বরে মাত্র ৬ বছর বয়সে অল বয়েজ ইয়ুথ টিমের কোচ নোরবার্তো প্রোপাতো পথ করে দিয়েছিলেন। তিনি তেভেজের চাচাকে রাজি করান ক্লাবের ফুটবল স্কুলে ছোট্ট তেভেজকে ভর্তি করানোর ব্যাপারে। কিন্তু সেটাতে চাচা রাজি হলেও একজোড়া বুট কিনে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না সেগুনডোর। কারণ তিনি স্বল্প বেতনে পাথর কাটা মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। কোনক্রমে দিনাতিপাত করতেন সেগুনডো। ১২ বছর পর বোকা জুনিয়র্সের অনুশীলন থেকে ফিরে আসেন তেভেজ একজন ভাল ফুটবলার হিসেবে। ততদিনে সেগুনডো চাকরিও হারিয়েছিলেন যখন তেভেজ ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। তেভেজের বাবা জুয়ান কার্লোস কাবরাল ও মা ফ্যাবিয়ানা মার্টিনেজের এখনও কোন খবর নেই। তেভেজও খোঁজ রাখেন না। কারণ তারা ছোট্ট তেভেজকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। চাচা সেগুনডো তাকে নিজের অভাবের সংসারেও ভরন-পোষণ করেছেন। যদিও সেগুনডোর নিজেরই ছিল ৫ সন্তান। এ কারণে সেগুনডোই তার বাবা এবং মা। সেগুনডোকেই সবকিছুতে খোঁজেন তেভেজ। বোকা জুনিয়র্সে থাকার সময় কোচ কার্লোস বিয়াঞ্চির অধীনে অনেক সম্মানজনক অর্জন জুটেছে তেভেজের। এর পেছনে রহস্যটাই ছিল তেভেজের আত্মনিয়োগ ও দারুণ কিছু করার জন্য প্রচেষ্টা। বিয়াঞ্চি সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তাকে বোঝার জন্য আপনাকে মাঠে তার মনোভাবটা কেমন সেটা দেখতে হবে। সে অবশ্যই অন্যদের চেয়ে আলাদা। প্রতিটি বলের জন্য সে লড়াই করে। তার মনোভাবটাই থাকে যেন এই বলটাই তার শেষ সুযোগ। সব সময়ই তার মধ্যে দারুণ কিছু করার তীব্র ক্ষুধা দেখেছি।’ শৈশবে শুধু মনস্তাত্ত্বিকভাবেই চরম দুর্দশায় কাটাননি, শারীরিকভাবেও চরম বিপর্যয়ে পড়েছিলেন তেভেজ। মাত্র ৯ মাস বয়সে ফুটন্ত পানি লেগে তার ঘাড় বিদঘুটেভাবে পুড়ে গিয়েছিল। সে কারণে ২ মাস থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে। ফোর্ট এ্যাপাচি এলাকায় থাকার কারণে তার উপাধিই হয়েছিল ‘দ্য এ্যাপাচি।’ এছাড়া ‘গণমানুষের খেলোয়াড়’ হিসেবেও তিনি স্বীকৃত। সবাই মমতা নিয়ে তেভেজকে ডাকেন ‘কার্লিটোস’ সম্বোধন করে। দারুণ ফুটবল দক্ষতার জন্য সব সসময়ই দারুণ কিছু প্রস্তাব পেয়েছেন, কিন্তু অর্থের পেছনে নিজে থেকে সেভাবে ছোটেননি কখনও। ২০১৫ সালে এক বছর চুক্তির মেয়াদ অবশিষ্ট থাকলেও জুভেন্টাস থেকে ভালবাসার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে ফিরে এসেছিলেন তেভেজ। অথচ মাত্র ২ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক দিয়েছিল তাকে বোকা। কিন্তু ইউরোপে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, ওয়েস্ট হ্যামের মতো নামী ক্লাবগুলোতে সবমিলিয়ে ৯ বছর কাটিয়ে ফেলেছিলেন। বোকায় ফেরার পর ফ্যাশনেবল শহর হিসেবে পরিচিত লা বোকা ও বুয়েন্স এইরেসে সময় কাটিয়েছেন তিনি।
×