ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৫ জুলাই ২০১৬

এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

হিংসায় উন্মত্ত আজ বিশ্ব। মানুষের ইতিহাসে কত শতাব্দী পার হয়ে গেল। কিন্তু এমন রক্তমাখা মূর্তি নিয়ে কোন শতাব্দী ইতিপূর্বে আসেনি এই বিশ্ব ভুবনে। যুদ্ধবিগ্রহ অল্প-বিস্তর পৃথিবীতে বরাবরই হয়েছে। শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের কথাও আমরা ইতিহাসে পড়েছি। কিন্তু এমন বিপুল আকারে এমন রক্তপিপাসু, মানুষ হত্যার দিন বোধহয় আর আসেনি। বিশ্বজুড়ে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ এমনই মাথাচাড়া দিয়েছে যে, বিশ্ববাসী আজ সন্ত্রস্ত। যে কোন সময় যে কোন স্থানে যে কেউ হয়ে যেতে পারেন খুন। আর জঙ্গীদের হাতে যদি পড়ে যায় পারমাণবিক অস্ত্র, তবে বিশ্বের ধ্বংস হতে আর দেরি নেই। মানুষ নিজের ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখে না বলেই ক্রমাগত একই ভুল করে যাবে, তা হওয়ার নয়। হিংসাশ্রয়ী মানুষকে প্রতিরোধ করা তাই আজ সচেতন বিশ্ব নাগরিকের প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীদের জয় কামনা যারা করেন, তারা মূলত মানুষ ও মানবতার শত্রুই বটে। সমস্ত সমাজ আজ সশস্ত্র জঙ্গীর সন্ত্রাসে আতঙ্কগ্রস্ত। কেউই বুঝি নেই আর স্বস্তিতে। চোরাপথে অজস্র অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে। গুপ্তপথে আসা অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে গুপ্ত ঘাতকের হাতে। অস্ত্র ব্যবসা যারা করছে সেসব দেশও নেই নিরাপদে। কিন্তু কেউ অস্ত্রের উৎস বন্ধ করার জন্য উদগ্রীব হয় না। শক্তিশালী দেশগুলো, যারা নিজ নিজ মতলবে দরাজ হাতে অস্ত্র সরবরাহ বা পাচার করছে, সেই অস্ত্র আবার তাদের দিকেই তাক করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে যেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের চর্চা মানবশক্তির অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। মনে হয় বিশ্ব আজ প্রকৃতিস্থ অবস্থায় নেই। কে কাকে সামলাবে, কে পথ দেখাবে? দেশে দেশে যারা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে বসে আছেন, তারা অধিকাংশই অতি সাধারণ মানুষ। পৃথিবীর মানুষকে শান্তিতে রাখবেন, এরা কেউ সে দরের মানুষ বলা যায় না। পৃথিবী আজ অভিভাবকহীন। আজ সারা পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ নেই যিনি বাক্যে চিন্তায় কর্মে মানবসমাজকে সর্বক্ষণ সচকিত রাখবেন। পৃথিবীর অভাব সম্পদের নয়; শক্তির নয়, সামর্থ্যরে নয়। অভাব মস্তিষ্কবান মানুষের, হৃদয়বান মানুষের, চরিত্রবান মানুষের, শান্তিকামী মানুষের। বিশ্বজুড়ে আজ যা চলছে তা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ নিরীহ মানুষকে অবলীলায় হত্যার মধ্যে বীরত্ব নেই, আছে পশুত্ব। পাশাবিকতার এই কালে মানুষ হতবুদ্ধি প্রায়। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে পতনের ঘেরাটোপে মানবসমাজ ধ্বংসের জয়গান গাইবে নির্বিকারভাবে। কিন্তু এই মানুষই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ার পথ ঠিকই আবিষ্কার করে নেবে। কারণ মানুষকেই বাঁচাবে মানবসভ্যতা। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মানুষই প্রতিরোধের মন্ত্র আওড়াবে। বিশ্বমানবকে সমস্ত ভয়ভীতির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে দাঁড়ানোর সময় এখন। বিশ্বমানবকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে এসব নারকীয় কর্মকা-ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা নিয়ে দেশে দেশে, মহাদেশে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বই আজ জঙ্গীবাদী তৎপরতার মুখোমুখি। বৈশ্বিক এই সমস্যার বিরুদ্ধে বিশ্বকে লড়তে হবে একসঙ্গে। এই উপলব্ধি আজ সব দেশের শাসক ও জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। তাই দেখা যায় এশিয়া-ইউরোপের দেশগুলো একত্রিত হয়ে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই এবং দুই মহাদেশের জনগণের স্বার্থে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে দিন দশেক আগে অনুষ্ঠিত একাদশ এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলনে (আসেম) দুই মহাদেশের নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সন্ত্রাসবাদ বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য গুরুতর হুমকি। টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তা প্রতিটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় মহাদেশীয় নেতাদের উপলব্ধি যথার্থ বলা যায়। আসেম হচ্ছে এশিয়া ও ইউরোপের নেতাদের নিয়মিত সংলাপ ও সহযোগিতার ফোরাম। প্রতি দু’বছর পর পর এই সম্মেলনের আয়োজন হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে। ওই বছরই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এবারের সম্মেলনে আসেমের কুড়ি বছরে পদার্পণে বর্তমানে সংঘটিত নানামুখী রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত করা হয়। আসেমভুক্ত ত্রিশটি ইউরোপীয় ও একুশটি এশীয় দেশ এবং দুটি আন্তঃসরকার সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও বাইশটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, এগারোটি দেশের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, ষোলোজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট এবং এসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনসের সেক্রেটারি জেনারেল দু’দিনব্যাপী সম্মেলনে যোগ দেন। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আসেমের কুড়ি বছর : যোগাযোগের মাধ্যমে আগামী দিনের অংশীদার।’ এর পূর্ববর্তী ২০১৪ সালে ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল : ‘প্রবৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বশীল অংশীদারিত্ব।’ এবারের সম্মেলন চলাকালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ও দমন যেমন ঘটেছে, তেমনি সম্মেলনের আগের দিন ফ্রান্সের নিস শহরে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার প্রভাব সম্মেলনে পড়েছে। তেমনি গত ১ জুলাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গী হামলাও ঘটে। যাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার নয়জন ইতালীয় ও সাতজন জাপানীসহ কুড়িজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পবিত্র ঈদের দিন ৭ জুলাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতের স্থল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় অন্তত চারজনের মৃত্যু ঘটে। সঙ্গত কারণেই সহযোগিতা বাড়াতে পূর্ব নির্ধারিত কর্মপন্থা নির্ধারণের পরিবর্তে এশিয়া ও ইউরোপের নেতাদের মনোযোগ বহুলাংশে কেড়ে নেয় জঙ্গীবাদ মোকাবেলার বিষয়টি। তাই আসেমের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকে বাস্তব ফল পেতে চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সন্ত্রাস ও সহিংস চরমপন্থা দমন, সমুদ্রসীমা সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, জলদস্যুতা ও সমুদ্রে সশস্ত্র ডাকাতি, মানব পাচার ও মাদক চোরাচালান, সাইবার নিরাপত্তা ও সাইবার অপরাধের মতো বিষয়ে অভিন্ন স্বার্থের প্রতি আসেম গুরুত্ব দেবে। সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা ঘোষণাপত্রে নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তারা আরও যোগাযোগ, পারস্পরিক স্বার্থে অংশীদারিত্ব এবং এশিয়া-ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারে একত্রে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তারা টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তা এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, জাতিসংঘ সনদের নীতি অনুসরণ, আইনের শাসন, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার, দুর্নীতি, অভিবাসন, ২০৩০ সাল নাগাদ এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়গুলো সামনে নিয়ে এসেছেন। এতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে তারা একযোগে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করার মাধ্যমে জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রগুলো সঙ্কুচিত হয়ে আসতে পারে। এই দুই মহাদেশের মানুষ দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তিতে বসবাস করার জন্য সচেষ্ট থাকলেও শান্তি সেভাবে আর আসছে না। বরং একুশ শতকে এসে অশান্তি, হিংসা, হানাহানির মাত্রা আরও বেড়েছে। ধর্মের ছদ্মাবরণে ধর্মকে কলুষিত করার লক্ষ্যে এবং বিশ্বজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি ও মানুষ হত্যার মতো পাশবিকতা সব শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছে। মানুষে মানুষে সন্দেহ, অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে। এই সময়ে এ সম্মেলনে ঘোষিত অঙ্গীকার মানুষের মধ্যে যেমন আশাবাদ জাগিয়ে তুলছে, তেমনি সন্ত্রাসের শিকড় ও উৎস উপড়ে ফেলার সমস্ত আয়োজন সফলভাবে মুখ দেখবেই। এবারের সম্মেলনে নেতারা ২০০৬ সালে আসেমের ভবিষ্যত নিয়ে দেয়া ‘হেলসিংকি’ ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেছেন নিজেদের সামগ্রিক স্বার্থেই। তারা পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যালোচনার মাধ্যমে আসেমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যোগাযোগের সম্প্রসারণ এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঅংশীদারিত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং পারস্পরিক মুনাফার দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতি তাদের প্রচেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংলাপ এবং সমবায় উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার অঙ্গীকার তুলে ধরেছেন, যা এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার দিগন্ত আরও উন্মোচন করবে। বৈশ্বিক রাজনীতি অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীলতা ও অসহিষ্ণুতার পথে ধাবিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সম্মেলনে বলা হয়েছে, আসেম তার ভূমিকাকে বাহন হিসেবে বহুমাত্রিকতা এবং আইনের শাসনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার পথে ধাবিত করবে। পাশাপাশি সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জনগণের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার অন্বেষণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং একটি মানসম্পন্ন জীবনের তাগিদে আসেমের মূল তিন স্তম্ভের সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। আসেম এশিয়া-ইউরোপের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালীকরণ, বহুমাত্রিক এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তুলতেও প্রচেষ্টা চালাবে। আসেমের যে কোন কর্মকা-ে এশিয়া ও ইউরোপকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা যাবে না। নেতারা বলেছেন, ভূ-রাজনীতির পালাবদল বিশ্বে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও গোলযোগের দিকে ঠেলে দেবার প্রেক্ষাপটে কার্যকর বহুপক্ষীয় সমন্বয় সাধন ও একটি নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার অনুঘটক হিসেবে আসেমের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে। এই ভাষ্য আশা জাগায়। দুই মহাদেশের দেশগুলোতে পারস্পরিক শত্রু মনোভাবাপন্ন পরিহার করে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য গড়ে তোলা জরুরী। এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং সেখানে বিকশিত জঙ্গীবাদ দুই মহাদেশকেই বিপর্যস্ত করতে চায়। এদের গুপ্তহত্যা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ চালানোর বিষয়গুলো দুই মহাদেশবাসীর জন্য অশনিসঙ্কেত। তাই জনগণ চায়, পারস্পরিক বিভেদ নিরসন করে একটি সহিষ্ণু বিশ্ব গড়ে উঠুক। সেই ক্ষেত্রটি অবশ্য আসেম সম্প্রসারিত করতে চায়। জনগণ থেকে জনগণ পর্যায়ে বৃহত্তর যোগাযোগ আন্তঃআঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং কার্যকর বহুপাক্ষিকতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও অন্যান্য বহুমুখী প্রক্রিয়া জোরদারের সুযোগ সৃষ্টিতে এই সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলে দুই মহাদেশবাসী স্বস্তি ও শান্তির আবহ ফিরে পেতে পারে। বাংলাদেশও লাভবান হতে পারে আসেমের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা কার্যকর হলে। দুই মহাদেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে আসেমের সিদ্ধান্ত ও অবদান বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রতীয়মান হয়। ‘এশিয়া-ইউরোপ সহযোগিতা রূপরেখা-২০০০’ অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ ও সহযোগিতার উদ্যোগ যেহেতু মূল ভিত্তি, সে কারণে বহুমাত্রিক ও জনকেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব আরও জোরদার হবে। এ সম্মেলন বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখী ও সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সুন্দর আগামী গড়ার দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ১৯৯৬ সালে গঠিত এ সংস্থায় বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে ২০১২ সালে। এ নিয়ে মোট তিনটি সম্মেলনে অংশ নিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের সম্মেলনে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল। তার প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত হয় পর্যালোচনার পর এবারের সম্মেলনে। আসেমের দেশগুলো নতুন প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র ও সংযোগস্থলে পরিণত হচ্ছেÑ এমনটাই উপলব্ধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। সম্মেলনে উল্লেখও করেছেন শেখ হাসিনা, দীর্ঘদিনের পরিচিত বাণিজ্য ও শিল্প অংশীদাররা এখন নতুনদের জন্য পথ করে দিচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে উৎপাদন ও সেবা খাতে ধারাবাহিক এবং দায়িত্বশীল বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে এবং পারস্পরিক আঞ্চলিক কর্মকা-ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। আশা শেখ হাসিনার যে, যথাযথ মান এবং সংহতি, বন্ধুত্ব, পারস্পরিক আস্থা ও সমতার মতো নীতির ভিত্তিতেই সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া যোগাযোগ তৈরিতে বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হলে জনগণের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন ঘটবে। সামগ্রিকভাবে এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণ বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল, দৃশ্যমান ও সুসংহত করেছে। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা কেবল প্রশংসিতই নয়, বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। গুলশানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশের সম্মান কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলা যায়। দেশে ফিরে এসে বিষণœকণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেছেনও, ‘আমাদের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া। আমরা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে কষ্ট লাগে যখন দেখি আমরা যে সম্মান অর্জন করেছিলাম, বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছিলামÑ এসব সন্ত্রাসী ঘটনায় সে সম্মানে কিছুটা হলেও ছেদ পড়ছে।’ অবশ্য শেখ হাসিনা তাতে হতাশ হননি। সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের আলোচনায় সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও উগ্রবাদ যে স্থানীয়ভাবে বেড়ে ওঠা এবং স্বাধীনতার পরাজিত গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে তার সরকারের সুদৃঢ় অঙ্গীকার এবং ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয়টি তুলে ধরে প্রমাণ করেছেন, এই জঙ্গীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা সম্মেলনে আহ্বানও জানিয়েছেন যে, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা, অর্থদাতা ও প্রশিক্ষণদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে কোথা থেকে অর্থ আসছে, কারা সেগুলো সরবরাহ করছেÑ সেসব চিহ্নিত করা জরুরী। অর্থাৎ সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের শিকড়-বাকড়, ডালপালা উপড়ে ফেলতে হলে সর্বাগ্রে তা চিহ্নিত করা যে জরুরী, এটা তিনি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। বিভিন্ন নেতার সঙ্গে পৃথক আলোচনায়ও তিনি এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশবিরোধী নেতিবাচক প্রচারণাকে তিনি খ-ন করে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশে যে আইএস নেইÑ সে বিষয়টিও তিনি স্পষ্ট করেছেন বিশ্বনেতাদের কাছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, জঙ্গীবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে। কিন্তু গুলশান হত্যার ঘটনা তাতে একটা ছেদ এনে দিয়েছে বলা যায়। তবে তা কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশীদের জন্য কঠিন হবে না। গুলশানের ঘটনার পর এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেখ হাসিনাকে বিষাদাচ্ছন্ন করেছে। মন খারাপ হওয়ার মতো ঘটনা অবশ্য। গত মে মাসের শেষদিকে জাপানে জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বেশ গৌরবের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেছেন। এর দেড় মাস পর অনুষ্ঠিত আসেম সম্মেলনে সেই উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। বরং বিষণœতায় ছিল ঢাকা। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে গত মে মাসে যে হার্দিক আলোচনা করেছেন, গুলশান ঘটনার পর আসেমে উভয়ের সাক্ষাত ছিল এক ধরনের বিষাদভারাক্রান্ত। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গুলশান ঘটনায় তার মাথা হেঁট হয়ে আসে।’ আসবারই কথা। বিশেষ করে বিদেশী নাগরিক হত্যা। উভয়ে ছিলেন শোকাভিভূত। নিহত জাপানী নাগরিকরা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কাজ করতে এসেছিলেন। এভাবে লাশ হয়ে ফিরে যাওয়াতে বাংলাদেশ ভীষণভাবে মর্মাহত। অবশ্য দুই দেশের মানুষই স্তম্ভিত, শোকাহত আজও। বেদনাদায়ক ঘটনা জাপানীদের মনে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করতেই পারে; কিন্তু তারপরও জাপান সরকার বাংলাদেশে তার প্রকল্প চালু রাখা ও সাহায্যদানে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস থেকে সরে আসেনি। তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকায়ন করার পক্ষে। ইতালীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতটিও ছিল শোকাবহ। ৯ জন ইতালীয় নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা শোকের মাত্রা বাড়িয়েছে। শেখ হাসিনা জঙ্গী নিধনে তার সরকারের তৎপরতাকে তুলে ধরেছেন। সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় অনেক দেশই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়। পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে জঙ্গীবাদকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী নির্মূল হবেই একদিন, উপড়ে যাবে সন্ত্রাসীদের শিকড়। কিন্তু সকলের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ যে সম্ভব নয়Ñ এটা দেশবাসীও জানে। তাই তারা আজ এক হয়ে প্রতিরোধী হয়ে পড়েছে।
×