ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

দুই যুগেও উচ্ছেদ নয়, গোমতী এখন দুর্গন্ধযুক্ত ‘মরা নদী’!

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ২৩:১২, ৫ জুলাই ২০২৫

দুই যুগেও উচ্ছেদ নয়, গোমতী এখন দুর্গন্ধযুক্ত ‘মরা নদী’!

দখল আর দূষণে কুমিল্লার এক সময়ের গর্ব গোমতী নদী এখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। শহরের বুক চিরে প্রবাহিত এই নদী আজ ‘মরা নদী’ নামে পরিচিত। দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। দুর্গন্ধ, পচা পানি, মরা প্রাণী আর আবর্জনায় পূর্ণ এই নদী এখন স্থানীয়দের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। অথচ ২০০৩ সালে শুরু হওয়া উচ্ছেদ পরিকল্পনা দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর পানি পচে গিয়ে কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে। দুই পাড়ের বাসিন্দারা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে মরা গরু, ছাগল, প্লাস্টিক ও মাদকের বোতল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, নদী এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ষাটের দশকে শহর রক্ষায় গোমতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি অংশ বিচ্ছিন্ন করা হয়, যা বর্তমানে ‘পুরাতন গোমতী’ বা ‘মরা নদী’ নামে পরিচিত। এই নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে ঘনবসতি ও অবৈধ দোকানপাট। কচুরিপানা, আবর্জনা আর দখলের ফলে নদীটি খালে পরিণত হয়েছে।থানা রোড, চাঁনপুর, গাংচরসহ বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনায় নদীর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মাছ চাষের জন্য জোর করে কচুরিপানা পরিষ্কার করা হলেও তা সাময়িক।

নদীপাড়ের বাসিন্দা জালাল সরকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সরকারি নদীতে মরা গরু, কুকুর আর আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। গন্ধে টেকা যায় না। অথচ কেউ কিছু বলছে না।”

পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান জানান, “৭৭২ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। তবে লোকবল সংকটে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে শিগগিরই উচ্ছেদ শুরু হবে।”

আদর্শ সদর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সাল থেকে একাধিকবার উচ্ছেদ নোটিশ দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১৬ সালে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটিও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। স্থানীয়দের মতে, বর্তমানে দখলদারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

চাঁনপুর এলাকার এক ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা বলেন, “সরকার যদি পুনর্বাসন করে উচ্ছেদ করে, তাহলে আমরা আপত্তি করবো না। কিন্তু হুট করে উচ্ছেদ করলে পরিবার নিয়ে কোথায় যাবো?”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি ডা. মো. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “গোমতী নদীকে ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে গড়ে তুললে এটি কুমিল্লার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে।”

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুন জানান, “২০২১ সালে একনেক সভায় গোমতী উন্নয়ন প্রকল্পে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু দখলদার উচ্ছেদ না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। কাজ চলমান রয়েছে।”

দখল-দূষণে মৃত্যুপ্রায় কুমিল্লার গোমতী নদী আজ কাঁদছে। দুই যুগ ধরে চলা ‘উচ্ছেদ পরিকল্পনা’ যেন ক্ষমতার দড়ি টানাটানির খেলায় বন্দি। গোমতী বাঁচাতে হলে এখনই চাই সাহসী ও কঠোর পদক্ষেপ।
 

 

রাজু

×