
শকুনি লেকের অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণপ্রেমীদের হাতছানি দেয়
লেক কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক যাই হোক, নিসর্গপ্রেমী যে কোনো মানুষের তা দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। আর তা যদি হয় আধুনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত, তাহলে তো আকর্ষণটা একটু বেশিই থাকে। এমনই এক দৃষ্টিনন্দন সরোবর শকুনি লেক। যার অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণপ্রেমীদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। শহরের প্রাণ কেন্দ্রের বিশাল এলাকাজুড়ে যে কৃত্রিম লেক রয়েছে, তা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে এমন কাকচক্ষু জলাধার, তাও আবার শহরের মধ্যে অবস্থিত। তাই এর আবেদন মানুষকে মুগ্ধ করে।
সারাদিনের ক্লান্তিশেষে প্রতিদিন সর্বস্তরের মানুষ বিকেলে ঘুরতে আসেন একটু প্রশান্তি পেতে। অনেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান মনের আনন্দে। শকুনি লেকের চারপাশের সড়ক প্রাতঃভ্রমণকারী সব বয়সী মানুষের শারীরিক কসরতের প্রসিদ্ধ স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে দেখা যায়, সমবয়সী কিশোর-কিশোরীদের প্রাণচাঞ্চল্য। অনেকে গাছের তলায় ও বটের ছায়ায় বসে খুঁজে বেড়ায় ছেলেবেলা।
চল্লিশের দশকে নগরায়ণের প্রয়োজনে যে লেকটি খনন করা হয়, বর্তমানে এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মানুষের মন কেড়ে নেয়। বর্তমানে শকুনি লেকের সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সাড়ে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে আরও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়। এখন সৌন্দর্য পিপাসু হাজারো মানুষ দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন সকাল-বিকাল ছুটে আসে লেকের পাড়ে।
সকালের নির্মল হাওয়া আর বিকালের পাঁয়চারি সে তো শহরবাসীর নিত্যদিনের ঘটনা। বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই লেকে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ খুঁজে পায় মনের প্রশান্তি। সব ঋতুতেই রাত অবধি চলে লেকের পাড়ে সর্বস্তরের মানুষের আসা-যাওয়া। লেকের এই বিনোদন কেন্দ্রকে ঘিরে এক শ্রেণির গরিব-অসহায় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভাসমান ফেরিওয়ালারাও পেয়েছে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। ইতোমধ্যে মাদারীপুর লেকের সুনাম-সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য জেলার বাইরে থেকেও লোকজন আসতে শুরু করেছে। মূলত কৃত্রিমভাবে লেকটি খনন করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে ফুটে ওঠে এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যবর্ধিত মনোমুগ্ধকর শকুনি লেক। লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা সব বয়সী মানুষের জন্য রয়েছে মুখরোচক নানা ধরনের খাবার দোকান। ভোজন রসিকদের জন্য রয়েছে মিনি চাইনিজ রেস্তোরাঁ ও ফার্স্টফুডের দোকান।
আছে পিঠাপুলি ও নামি-দামি চটপটি-ফুসকার সমাহার। শিশুদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পৌর শিশুপার্ক, খেলনার দোকান। লেকের পাড়ে রয়েছে তিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। একটি স্বাধীনতা অঙ্গন, শহীদ কানন চত্বর ও দক্ষিণপাড়ে মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন। সারাবছর শহরকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জাতীয় দিবসের কর্মসূচিসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জন্য স্বাধীনতা অঙ্গনটি উন্মুক্ত। সেদিনের সেই কৃত্রিম লেক আজ এক দৃষ্টিনন্দন সরোবর এবং সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র।
বহিরাগত যে কেউ মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করেই এই লেকের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেই। লেকের পশ্চিম পাড়ে রয়েছে লেক ভিউ ক্লাব, উদয়ের পথে শিশু বিদ্যালয় (বর্তমানে ডিসি একাডেমি), নির্মাণ করা হয়েছে জেলা সদর মডেল মসজিদ। দক্ষিণে সার্কিট হাউস, জাতীয় মহিলা কল্যাণ সংস্থা ভবন, ওয়াচ টাওয়ার বা সেল্ফি টাওয়ার জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভবন, বাবু চৌধুরী জেনারেল হাসপাতাল। লেকের পূর্ব পাড়ে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতাল, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, পুরানো কারাগার, (কয়েদি নতুন কারাগারে স্থানান্তরিত) পুলিশ লাইনস ময়দান।
উত্তরে ‘ল’ কলেজ, সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সরকারি বাসভবন এবং বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল। ১০তলাবিশিষ্ট দেশের প্রথম সমন্বিত সরকারি অফিস ভবন, সাবেক ট্রেজারি ভবনকে সংস্কার করে গড়ে তোলা হয়েছে মাদারীপুর মিউজিয়াম।
দৃষ্টিনন্দন এই শকুনি লেকের কাজল কালো স্বচ্ছ জল আর শীতল হাওয়ায় ক্লান্ত পথিকরা ক্ষণিকের জন্য হলেও লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে গা জুড়িয়ে নেয়। পড়ন্ত বিকালে দূর থেকে লেকের চেহারায় ফুটে ওঠে প্রকৃতির ছবি। এ যেন কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যপট। এই শকুনি লেকটি শতশত বছরের পুরানো মাদারীপুর শহরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। সন্ধ্যার পরে নানা বর্ণের আলোর ঝলকানিতে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ফুটে ওঠে শকুনি লেকে।
১৯৪২-৪৩ সালে মাদারীপুর শহরের মাঝামাঝি শকুনি মৌজার ভাগাড় এলাকার ২০ একর জমি নিয়ে এই লেকটি খনন করেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সেরাজুল করিম। ১৯৩৭-৩৯ সালের দিকে আড়িয়ালখাঁ নদের ভাঙা-গড়ার খেলায় যখন মাদারীপুর মূল শহরের (বর্তমান লক্ষ্মীগঞ্জ) অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে। তখন নতুন করে শহর স্থানান্তরের জন্য মাটির প্রয়োজনে ১৯৪২-৪৩ সালে এই শকুনি লেক খনন করা হয়। সে সময় এই এলাকাটি ছিল জনমানবহীন এবং বনজঙ্গলে ভরা একটি অসমতল হাজামজা জলাশয়।
নদীভাঙন কবলিত তৎকালীন মহকুমা শহরের কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, থানা, জেলখানাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলো স্থানান্তরের জন্য এই এলাকাটি বেছে নেওয়া হয়। কারণ, সমতলে এ সব স্থাপনা তৈরির জন্য প্রচুর মাটির প্রয়োজন হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মাদারীপুর মহকুমা প্রশাসন এই লেকটি খনন করে মাটির চাহিদা পূরণ করেন। পরবর্তীতে লেকের চারপাশে ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হয় সরকারি ওই সকল স্থাপনা।
চল্লিশের দশকে প্রচুর মাটির প্রয়োজনে বিশাল এই লেকটি খনন করতে বহু সংখ্যক মাটিকাটা শ্রমিক দরকার হয়। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এ অঞ্চলে না থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সময় ভারতের বিহার/হরিয়ানা ও ওড়িশা অঞ্চল থেকে প্রায় দুহাজার মাটি কাটা শ্রমিক আনা হয়। লেক খননের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ওড়িয়ার নাঞ্জিপুঞ্জি নামের এক আদিবাসীকে। নাঞ্জিপুঞ্জির তত্ত্বাবধানে ভারতের ঐ তিন রাজ্য থেকে আসা দুহাজার শ্রমিক ২০ একর জায়গার মাটি কেটে লেক খনন শুরু“ করে।
১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালের মধ্যে লেকটির খনন কাজ করার সম্পন্ন করার কথা। কিন্তু প্রায় ৯ মাস লেকের খনন কাজ সম্পন্ন হওয়ার শেষ মূহূর্তে এ অঞ্চলে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন খনন কাজে নিয়োজিত ৭ জন শ্রমিক কলেরায় মারা গেলে অন্যান্য শ্রমিক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং লেকের কাজ অসমাপ্ত রেখে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান। যে কারণে লেকটি সমান চতুষ্কোণ হয়নি। শকুনি লেকের মাঝে বেশ কয়েকটি মাটির ঢিবি রয়ে যায়।
১৮৭৫ সালে মাদারীপুর মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই মিউনিসিপ্যালিটি, পুরানো শহর ও আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ও মরা কুকুর বিড়াল, মরা গরু-ছাগল ও অন্যান্য জঞ্জাল ফেলা হতো শকুনি নামক জনশূন্য খানা-খন্দে ভরা বন-জঙ্গলের এই ভাগাড়ে। ভয়ে ও দুর্গন্ধে ওই স্থান দিয়ে কেউ চলাচল করতেন না এবং এর চারপাশে কোনো পথ বা জনবসতিও ছিল না। সেখানে শিয়াল-কুকুর, বাগডাসা, নানা বন্যপ্রাণী, পশু-পাখি এবং প্রচুর শকুন পড়ত ওইসব মরা খেতে।
জনশ্রুতি রয়েছে, ব্রিটিশ সরকারের আমলারা মুখে মুখে এই জায়গাকে প্রথমে শকুন্ত এবং পরে শকুনি বলতেন বলে এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়। তাতে এই ধারণা করা যায় যে, শকুনি নামের উৎপত্তি ১৮৭৫ সালের আগে পরে হতে পারে। বাংলা একাডেমির পরিচালক, বিশিষ্ট কবি, ফোকলোরবিদ ও গবেষক ড. তপন বাগচী ও আশির দশকের তুখোর ছাত্রনেতা লণ্ডন প্রবাসী জাকির হোসেন, ফ্রেন্ডস অব নেচার, মাদারীপুরের প্রতিষ্ঠাতা ও শকুনি মৌজার বাসিন্দা রাজন মাহমুদ এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে আরও জানা গেছে, মাদারীপুরের বর্ষীয়ান ব্যক্তি বাবু চৌধুরী জেনারেল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা নূরুল আলম বাবু চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক মিয়া ও প্রকৌশলী সামসুল হক কাছ থেকে।
তারা সন তারিখ বলতে না পারলেও ১৯৪২ সালের কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ আমলে প্রথম যে সিএস রেকর্ড হয়, তখন ব্রিটিশ সরকার শকুনি, পানিছত্র ও সৈদারবালি মৌজার নামে রেকর্ডভুক্ত করে। অপর একটি সূত্র মাদারীপুর সহকারী সেটেল্টমেন্ট অফিসের কর্মকর্তা রাশেদ আলম বলেন, ‘শকুনি মৌজার নামকরণ অনেক আগেই হয়েছে। কারণ, এই শকুনি মৌজার সি,এস রেকর্ড হয় ১৯৩০ সালে, আর,এস রেকর্ড হয় ১৯৪২ সালে, এস,এ রেকর্ড হয় ১৯৬২ সালে আর বি,আর,এস হয় ২০০১ সালে। এ থেকে ধারণা করা হয়, শকুনি মৌজার উৎপত্তি ব্রিটিশ আমলে।
বর্তমানে শকুনি মৌজা শহরের ভিআইপি এলাকা উন্নয়নের ছোঁয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে দুটি সুপ্রশস্ত সড়ক। ১নং শকুনি রোড এবং ২নং শকুনি রোড। এই দুটি সড়কের দুইপাশে গড়ে উঠেছে বহুতল বিশিষ্ট অসংখ্য আবাসিক ভবন, বিপণি বিতান, হোটেল রেস্তোরাঁ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল। এখানে বারোমাসই মেলা বসে। এমন মনকাড়া দৃশ্য জেলায় দ্বিতীয়টি নেই।
১৮৫৪ সালে মাদারীপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। তখন শকুনি মৌজার জমিজমা সংক্রান্ত আংশিক কাগজপত্র পাওয়া যায়। ১৮৭৫ সালে মাদারীপুর মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে জমিজমার কাগজপত্রে শকুনি মৌজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।