
যে যেখানেই থাকুক, মাটি ডাকে। ইতিহাসও তেমনি তার অনন্ত সাক্ষ্যগুলো ছড়িয়ে রেখে ডাকে আমাদের—পদ্মা-ইছামতীর তীরে, বিক্রমপুরের মাটি ছুঁয়ে থাকা অতীতের দিকে। সেই অতীতের এক বিস্ময়কর প্রতীক হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে শ্যামসিদ্ধির মঠ—নিঃশব্দ অথচ উচ্চকিত এক প্রত্নচিহ্ন।
মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার শ্যামসিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত এই মঠটি কেবল একটি স্থাপত্য নয়, এটি দক্ষিণবঙ্গের আকাশছোঁয়া সাহস, শিল্প ও স্মৃতির প্রতীক। ২৪৭ বছরের পুরনো এই মঠটির উচ্চতা প্রায় ২৪১ ফুট, যা ভারতের কুতুব মিনারের চেয়েও ৫ ফুট বেশি! অথচ অবাক হতে হয়, ইতিহাসের এমন এক নিদর্শন আজ নিঃসঙ্গ, প্রায় নিঃশেষ, অপমানিত আর বিস্মৃত।
বলা হয়, বিক্রমপুরের ধনাঢ্য জমিদার সম্ভুনাথ মজুমদার এক রাতে স্বপ্নে দেখেন—তার প্রয়াত পিতার চিতার উপর একটি মঠ নির্মাণ করতে হবে। স্বপ্নে পাওয়া সেই নির্দেশকেই বাস্তব রূপ দেন তিনি। তিনি গড়ে তোলেন অষ্টভুজ আকৃতির এক অনন্য মঠ, যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান—প্রায় ২১ ফুট। মঠটির অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছিল একটি তিন ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ।
এ যেন এক আধ্যাত্মিক স্মারক, প্রেম আর পারলৌকিক শ্রদ্ধার মিলনস্থল।
ভারতের দিল্লির কুতুব মিনারের উচ্চতা ২৩৬ ফুট—ইতিহাস বইয়ে পড়া সেই অট্টালিকা। কিন্তু সেই তুলনায় আরও পাঁচ ফুট উঁচু বিক্রমপুরের শ্যামসিদ্ধির মঠ, যেটিকে অনায়াসেই উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মঠ ও স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! কুতুব মিনার যেখানে সংরক্ষিত ও পূজিত, সেখানে শ্যামসিদ্ধির মঠ আজ বিলুপ্ত প্রায়। দরজা-জানালার কাঠের কারুকাজ, গায়ের পাথরের অলংকরণ, এমনকি পিতলের কলসি ও তাম্রলিপিগুলো চুরি হয়ে গেছে বহু আগেই।
১৯৯৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গটিও চুরি হয়ে যায়।
মঠটি যখন নির্মিত হয়, তখন এই অঞ্চল বিক্রমপুর নামেই পরিচিত ছিল। প্রাচীন বাংলার জ্ঞান, সাধনা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই অঞ্চল। মঠগুলো ছিল সন্ন্যাস, ধ্যান, জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার স্থান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন “মঠগুলো মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শ্যামসিদ্ধির মতো মঠগুলো সংরক্ষণ করলে বিক্রমপুর পর্যটনের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।”
আমাদের দেশে অনেকেই কুতুব মিনার দেখতে ভারতে যান। অথচ বিক্রমপুরে দাঁড়িয়ে আছে কুতুব মিনারের চেয়েও উঁচু স্মৃতিস্তম্ভ—যা জ্ঞান, ইতিহাস আর শিল্পকলার এক বিস্ময়কর নিদর্শন।
কিন্তু নেই কোনও পর্যটন নকশা, নেই সরকারি প্রচারণা। কেবল স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে থাকা গল্পে বেঁচে আছে শ্যামসিদ্ধির মঠ।
জানা যায়, “মঠটির ভিত্তি টাইলস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে, যা প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য রক্ষার নীতিমালার পরিপন্থী। এভাবে সংস্কার না করে বরং এর আসল রূপ ফিরিয়ে আনা জরুরি।”
মঠ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়—এটি একটি সময়ের কণ্ঠস্বর, যা আজও বাতাসে বলে যায়, “তোমরা যারা ইতিহাস জানো না, তারা ভবিষ্যতের আলোকও দেখবে না।”
শ্যামসিদ্ধির মঠকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন পরিকল্পনা, গবেষণা কেন্দ্র, এবং স্থানীয় সংস্কৃতি বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এটি হতে পারে আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস পুনর্জাগরণের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।
রাজু