
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ফেনী জেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন। দেশের অন্যতম পুরাতন জনপদ হিসেবে বিবেচিত ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাচীন স্থাপত্য, নিদর্শন ও প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশেষ করে ছাগলনাইয়া উপজেলা সেই প্রাচীনত্বের ধারক ও বাহক। এখানকার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে বহু পুরাকীর্তির নিদর্শন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এক ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো—ছাগলনাইয়ার সাত মন্দির, যা সাত মঠ নামেও পরিচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক তালিকাভুক্ত মঠ
ছাগলনাইয়ার এই সাত মঠ বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক তালিকাভুক্ত একটি ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক নিদর্শন। এই মঠগুলো শুধু ধর্মীয় বা জমিদার সংস্কৃতির প্রতিফলন নয়, বরং তৎকালীন সময়ের শিল্পনৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিরও এক জীবন্ত প্রমাণ।
জমিদার বাড়ির ইতিহাস
এই মঠগুলো নির্মিত হয়েছিল হিন্দু জমিদার বিনোদ বিহারী মজুমদার এর জমিদারবাড়ির অংশ হিসেবে। প্রায় আট একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয়েছিল বিশাল এই রাজবাড়ি ও সংলগ্ন মন্দিরসমূহ। এর অবস্থান ছাগলনাইয়া উপজেলার বর্তমান শহরের পশ্চিম পাশে বাঁশপাড়া গ্রামে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাতটির মধ্যে একটি মঠের চূড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, ফলে দূর থেকে দেখলে এখন কেবল ছয়টি চূড়া দৃশ্যমান। এগুলো মূলত চিতা মন্দির, যেখানে অতীতে জমিদার পরিবারের সদস্যদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হতো।
এই কারণে জমিদারবাড়িটি পরিচিতি পেয়েছে সাত মন্দির বাড়ি, সাত মঠ অথবা রাজবাড়ি নামে।
নকশা ও স্থাপত্যশৈলীর বৈচিত্র্য
সাতটি মঠের স্থাপত্যে রয়েছে চমকপ্রদ ভিন্নতা ও কারুকাজ। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে খচিত আছে নান্দনিক অলঙ্করণ ও সূক্ষ্ম শিল্প। আশ্চর্যজনকভাবে মঠগুলো এক সারিতে নয়—বরং দুটি সারিতে স্থাপিত। এক সারিতে রয়েছে তিনটি, অপর সারিতে চারটি, যা একত্রে একটি সমকোণ বিন্যাস গঠন করেছে।
প্রতিটি মঠের চূড়ার গঠন আলাদা, যেটি স্থপতিদের ভিন্ন চিন্তা ও শিল্পনির্মাণ ক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করে। এমন ধারাবাহিক মঠবিন্যাস বাংলাদেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না—এটাই একে করে তুলেছে অদ্বিতীয়।
সময়ের ধাক্কায় জমিদারশূন্য প্রাসাদ
দেশভাগের উত্তাল সময় ১৯৪৮ সালে জমিদার বিনোদ বিহারী তাঁর সকল সম্পদ ফেলে চলে যান কলকাতায়। এরপর জমিদারবাড়িটি আর ফিরে পায়নি আগের জৌলুশ। বর্তমানে স্থানীয় কিছু পরিবার ঐ রাজবাড়ির জায়গাতেই বসবাস করছেন। তবুও জমিদারির সেই ছায়া এখনও ঘুরে বেড়ায় সাত মঠের প্রতিটি ইটে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ
ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংস্কার কাজ চালাচ্ছে। প্রাচীন নকশা অক্ষুণ্ন রেখেই মঠগুলো পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে ধীরে ধীরে। তবে সংরক্ষণ ও পরিচর্যার পাশাপাশি পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রাচীন স্থাপনাটিকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র।
ছাগলনাইয়ার সাত মঠ কেবল একটি প্রাচীন স্থাপনা নয়, এটি এক গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক। শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জমিদারিয়ত—সবকিছুর সংমিশ্রণে এই মঠগুলো হয়ে উঠেছে একটি স্থাপত্যশৈলীর বিস্ময়। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ—যাতে ইতিহাস মুছে না যায়, বরং নতুন প্রজন্ম তা ছুঁয়ে দেখতে পারে।
রাজু