
ছবি: জনকণ্ঠ
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদে মানত কিংবা দান-খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এমন বিশ্বাস থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে আসেন এই মসজিদে।
তারা নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, কোরআন শরীফ, মোমবাতি ও আগরবাতি দান করেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এই মসজিদে মানত নিয়ে আসা মানুষের ঢল নামে। তখন অতিরিক্ত মানুষের কারণে ওই অঞ্চলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
দেশের দূরদূরান্ত থেকে আগত প্রত্যেক মানুষেরই একটিই বিশ্বাস। যেকোনো মনোবাসনার উদ্দেশ্যে এখানে দান করলেই তার আশা পূর্ণ হবে। আর যাদের দানের সামর্থ্য নেই, তারা মনে করেন এখানে এসে দানের পরিবর্তে নফল নামাজ আদায় করলেও মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত, নরসুন্দা বিধৌত, হাওড় অধ্যুষিত, কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দিরসহ নানা বৈচিত্র্যের ধারক এই কিশোরগঞ্জ জেলা। প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো তারই একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো পাগলা মসজিদ, যা শহরের প্রাণকেন্দ্রে আকাশছোঁয়া সুউচ্চ মিনারে দাঁড়িয়ে আছে।
মসজিদের ইমারত অত্যন্ত সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীতে চমৎকার বলা চলে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
মসজিদটি একটি সাধারণ ধর্মীয় স্থাপত্যের কাঠামো অনুসরণ করে নির্মিত প্রধান প্রার্থনা কক্ষ, ছাদের উপর অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ এবং উঁচু মিনারসহ। এছাড়া বিভিন্ন ভূখণ্ডের সংস্কৃতি ও ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় রেখেই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে। পাগলা মসজিদটি কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, আধুনিক সদর হাসপাতাল ও নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত।
মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে এক আধ্যাত্মিক পাগলবেশী ব্যক্তি খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের স্থানে অবস্থান নেন। পরে তাঁকে ঘিরে ভক্তদের সমাগম ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর সমাধির পাশে এই মসজিদটি নির্মিত হয়।
অন্য একটি মতে, হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামক এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এখানে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে মসজিদের নাম হয় ‘পাগলা মসজিদ’।
আরও একটি মত অনুযায়ী, পাগলা বিবি নামের এক জমিদার বংশীয় নারীর নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে মসজিদটির নাম ‘পাগলা মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স’।
মসজিদটির জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। প্রথমে জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, যা হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির ওয়াকফকৃত। বর্তমানে এটি তিনতলা বিশিষ্ট, ছাদে রয়েছে ৩টি গম্বুজ ও পাঁচতলা ভবনের সমান একটি মিনার। এখানে একসাথে প্রায় ৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে পৃথক নামাজের ব্যবস্থা।
২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর মসজিদের দানবাক্স খুলে রেকর্ড ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার ৪২৩ টাকা পাওয়া যায়। এরপর ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল আরও একবার দানবাক্স খোলা হলে নতুন রেকর্ড হয় ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা, সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কারও পাওয়া যায়।
এই মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছেই নয়, বরং সকল ধর্মাবলম্বীর কাছেই পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। অনেকের বিশ্বাস, কেউ সঠিক নিয়তে দান করলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ এখানে বিপুল পরিমাণ দান করেন।
তবে পাগলা মসজিদে দানের বিষয়ে আলেমদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র মতামত। কেউ বলেন, মসজিদে দান করা নেকির কাজ; তবে শুধুমাত্র এই মসজিদে দান করলেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে এমন ধারণা ইসলাম পরিপন্থী নয়। আবার কেউ মনে করেন, এমন বিশ্বাস শরীয়ত-বিরোধী এবং কুসংস্কার। তাদের মতে, দানের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া উচিত এবং তা হওয়া উচিত কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
শহীদ