
ছবি: সংগৃহীত
এক সময় মেঘনা নদীর করাল গ্রাসে ছিল লক্ষ্মীপুর জেলার অধিকাংশ এলাকা। কালের পরিক্রমায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে জেলার পশ্চিম অংশে সরে গেলে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। এরই মধ্যে একটি এলাকায় জেগে ওঠা চরে দুইটি রহস্যময় লোহার বস্তু—যা স্থানীয়ভাবে 'বয়া' নামে পরিচিত—দেখা যায়। ওই বয়ার নাম অনুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় ‘বয়ারচর’।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৭০ বছর আগে মাটির নিচ থেকে দেখা মেলে এই দুটি বয়ার। লোহার তৈরি বয়াগুলো দেখতে অনেকটা গ্যাস সিলিন্ডারের মতো। এগুলোর উচ্চতা ছিল আনুমানিক ২০-২৫ ফুট। বর্তমানে মরিচা ধরে ক্ষয়ে গেলেও এ বয়াকে ঘিরে রহস্য আর কৌতূহলের শেষ নেই।
ফসলি জমির মধ্যে পড়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরউভূতি গ্রামের একটি ফসলি মাঠে মাটির ভেতরে পোঁতা অবস্থায় রয়েছে বয়াগুলো। মাটির উপরের অংশে হাতল সদৃশ রিং দেখা গেলেও কতটুকু অংশ মাটির নিচে রয়েছে, তা কেউই জানেন না।
স্থানীয়দের ভাষ্য, এক সময় এই এলাকাজুড়ে নদী ছিল। ফরাশগঞ্জ নৌবন্দরে যাতায়াতকারী বড় বড় নৌযান চলাচলের জন্য নদীপথে দিক-নির্দেশনা দিতে ব্রিটিশ আমলে এসব বয়া স্থাপন করা হয়। নদী সরে গিয়ে চর জেগে ওঠার ফলে বয়াগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। কালের বিবর্তনে মাটি সরে গিয়ে বয়ার উপরের অংশ দৃশ্যমান হয়।
রহস্য, কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাস
বয়াগুলোকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিভিন্ন কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাসও গড়ে ওঠে। ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা মমিন উল্যাহ জানান, “পানি শুকিয়ে চর জাগার পর মানুষ চাষাবাদ করতে গিয়ে বয়াগুলো দেখতে পায়। এরপর অনেকে মানত করত, মিলাদ পড়াত, টাকা-পয়সা দান করত। কেউ কেউ সালাম করে পাশের মাটি নিয়ে তাবিজ বানাত।”
তবে এখন সেই চর্চা অনেকটাই বিলুপ্ত। তবুও অনেকের বিশ্বাস, যদি বয়াগুলো সরানো হয়, তবে এলাকার ক্ষতি হতে পারে বা আবার নদী ফিরে আসতে পারে।
প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা চায় স্থানীয়রা
বয়াগুলো স্থানীয় জনগণের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এখনো পর্যন্ত এগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সচেতন মহল মনে করে, জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় এগুলো সংরক্ষণ করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জলপথের বিবর্তন তুলে ধরা সম্ভব হবে।
বয়ার প্রকৃত পরিচয় কী?
নৌযান চলাচলের দিক নির্দেশনায় ব্যবহৃত ‘বয়া’ হলো একটি ভাসমান চিহ্ন, যা নদী বা সাগরের নির্দিষ্ট স্থানে নোঙর করে রাখা হয়। বয়ার সঙ্গে শিকল ও অ্যাংকর দিয়ে পানির তলদেশে সংযুক্ত করা হয়, যাতে এটি স্থির থাকে। সাধারণত বিপদসংকুল এলাকা, যাতায়াতপথ কিংবা সীমানা নির্ধারণে এসব বয়া ব্যবহৃত হয়। বর্তমান সময়ে এসব বয়ার পাশাপাশি বিকন বাতিও ব্যবহার হচ্ছে।
ইতিহাসে ফিরে দেখা
‘লক্ষ্মীপুর ডায়েরি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভাষাসৈনিক কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা ১৯৫৫ সালে লক্ষ্মীপুর থেকে রামগতি পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন। এরপর মেঘনা নদী পশ্চিমে সরে গিয়ে বর্তমান অবস্থানে আসে। তখন থেকেই বয়াগুলো মাঠে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে এ বয়া কখন স্থাপন করা হয়, কারা এনেছে বা ঠিক কী কারণে এখানে এসেছে—তা আজও রহস্যই রয়ে গেছে।
আলীম