
রামগঞ্জে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণের ঘরে উপকারভোগীরা না থাকায় মাদকসেবীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে বলে জানা গেছে। উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়নে রাজনীতিক প্রভাব ও যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করায় যাদের নিজস্ব বাড়ি ও জমিজমা রয়েছে, এ ধরনের বেশীরভাগ ব্যক্তিরা ঘরগুলো বরাদ্দ পায়। বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ৬০ভাগ ব্যাক্তি ঘরগুলোতে থাকছেন না। এ সুযোগে ফাঁকা ঘরগুলোতে মাদকসেবীসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিকট থেকে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় নিয়েছেন।
শনিবার (২১ জুন) ও রবিবার (২২জুন) সরেজমিনে গিয়ে এ সব আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যক্তির সাথে কথা বললে তাঁরা এ তথ্য দেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তাবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় রামগঞ্জে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ম থেকে ৩য় পর্যায়ে ১০টি স্থানে মোট ৩১৫টি ঘর নির্মান করা হয়। নির্মানকৃত ঘরগুলো হল-৬নং লামচর ইউনিয়নে লামচর দিঘীর পাড়ে‘ ৩৭টি, ৫নং চন্ডিপুর ইউনিয়নের গনেশের বাড়ি পাশে ৭৯টি, ফতেপুর ৩টি, সুরেরবাঘে ১০টি, মাছিমপুর স’মেইলের পাশে ১৫টি, ৪নং ইছাপুর ইউনিয়নের কাউনিয়া বাজার ৩৩টি, শ্রীরামপুর কোচের বাড়ি পাশে ৪টি, শ্রীরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পাশে ৯৪টি, ৩নং ভাদুর ইউনিয়নের রাজারামপুর ২৬টি, ২নং নোয়াগাও ইউনিয়নের পূর্ব নোয়াগাও ১৪টি। ঘর বরাদ্দের প্রধান শর্ত গৃহহীন ও ভুমিহীন ব্যক্তি হতে হবে।
উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটি নীতিমালা অনুযায়ী ঘর বরােেদ্দর জন্য উপকারভোগী তালিকা করেন। প্রতিটি ঘরে নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। নির্মাণের কয়েক মাসের মধ্যে ২শতক জমির দলিলসহ ঘরগুলো বরাদ্দপ্রাপ্তদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৪নং ইছাপুর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশের আশ্রয়ণ প্রকল্পে বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৫জন বাসিন্দা জানান, এই প্রকল্পে মোট ৯৪টি ঘর আছে। এদের মধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্ত ৪৩ জন বসবাস করেন। বাকী ৫১ জন নিজেরা বসবাস করেন না। অনেকে ঘর ভাড়া দিয়েছেন। ১০ থেকে ১২টি ঘর খালি আছে। তারা আরো জানান, ঘরগুলো বরাদ্দ বুজিয়ে দেওয়ার পর প্রশাসনের কেউ খোজখবর নেন না। ঘর ভাড়া নেওয়া কয়েকজন বাসিন্দাসহ বাহির থেকে সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, জুয়াড়ী নিয়মিত আসা যাওয়া করে। প্রতিদিন জুয়া, মাদকসেবনের আসর বসে।
কেউ কিছু বললে তাদেরকে হুমকী ধমকী দিচ্ছে, এ জন্য ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। ৫নং চন্ডিপুর ইউনিয়নের গনেশের বাড়ির পার্শ্ববর্তী আশ্রয়ন প্রকল্পের বরাদ্দপ্রাপ্ত বাসিন্দারা ভয়ে কথা বলতে চায় না। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ৪ জন জানান, সন্ধ্যা নামলেই আশ্রয়ণ এলাকায় গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশ্রয়ণের কয়েকজন বাসিন্দা যোগসাজসে বাহির থেকে মাদক কারবারি, সন্ত্রাসী, খারাপ নারীরা আসা যাওয়া শুরু করে। এ আশ্রয়ণের প্রকল্পে প্রকৃত বরাদ্দ প্রাপ্ত ৩০ থেকে ৩৫ ছাড়া বাকী সব বাহিরের লোক বসবাস করেন।
৬নং লামচর ইউনিয়নের লামচর দিঘীর পাড়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায় বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫ জন ব্যাক্তি বসবাস করছেন। ১৭জন অন্যের নামে বরাদ্দের ঘর থাকছেন। ৫টি ঘর ফাঁকা রয়েছে। এই প্রকল্পে মোট ৩৭টি ঘর আছে। আশ্রয়নের ঘরের নারী পুরুষসহ ৭জন বাসিন্দা জানান, রাত আসলে আশ্রয়ন ঘরের বারিন্দায় ও খালি ঘরে বাহির থেকে মাদকসেবীরা এসে আড্ডা জমায়। এছাড়াও রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন সমস্যায় কারনে এখানে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। তারা প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। এভাবে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। প্রকৃত ভূক্তভোগীরা ঘর বরাদ্দ পায়নি। পেয়েছেন তৎকালীন আওয়ামীলীগের লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের লোকজন। তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনভাবে স্থানীয় ভুমিহীন ও গৃহহীনদের বরাদ্দ দেওয়া জন্য প্রশাসনের নিকট দাবি করেন।
এ ছাড়াও মাদকসেবীর আড্ডাসহ বিভিন্ন অপকর্মে বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াও দাবি জানান। লামচর গ্রামের জাকির হোসেন, শ্রীরামপুর গ্রামের আবদুল্লাহ,ভাদুরের সোহেল ও আনোয়ার হোসেনসহ অনেকে জানান, সরকার গরিবদের ভালোর জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় ঘর করে দিয়েছেন। কিন্তু সে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন যাদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি আছে তাঁরা। এখন তারা না থাকায় মাদকসেবীদের আড্ডার জায়গা হয়েছে। এলাকায় চুরি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
এ ব্যাপারে প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে আশ্রয়ণ প্রকল্প গুলো সমাজের জন্য ক্যান্সারের মতো পরিনত হবে। রামগঞ্জ মডেল ডিগ্রী কলেজের সহকারি অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অভাবে তা ভেস্তে যেতে বসেছে। এই প্রকল্প গুলোতে বাস্তÍহীন, গরিব মানুষ গুলিকে জড়ো করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান, পর্যাপ্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়নি।
তাই অভাবের তাড়নায় অনেকে চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। প্রকল্প এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, ছোট বড় শিল্প কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তাদেও কাজের ব্যবস্থা করা জরুরি। তাই প্রশাসন ও স্থানীয় বিত্তবান এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে এ সব গরিব জনগণ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে।
রামগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল বাশার জানান, মাদক বন্ধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। খোজখবর নিয়ে আশ্যয়ণ প্রকল্প গুলোতে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ মোহাম্মদ রবিন শীষ জানান, বরাদ্দ পাওয়ার পরও যারা ঘরে থাকছেন না, তাদের দলিল বাতিল করে নতুনদের বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও রাস্তা, ঘাটসহ যে সকল সমস্যা আছে তা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রিফাত