ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

মিরসরাইয়ে ট্রেন ধাক্কায় নিহত স্বামী

প্রেম করে বিয়ের ১৭ দিনের মাথায় বিধবা হলেন মারুফা

ফিরোজ মাহমুদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ২০ জুন ২০২৫

প্রেম করে বিয়ের ১৭ দিনের মাথায় বিধবা হলেন মারুফা

ছবিঃ জনকণ্ঠ

২ বছর প্রেমের সম্পর্কের পর গত ৩ জুন টাঙ্গাইলের মেয়ে আক্তারকে বিয়ে করেন আনিস। বিয়ের ১৭ দিনের মাথায় বিধবা হলো মারুফা। তার বাবা-মা শুক্রবার সকালে টাঙ্গাইলে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান তাকে।

মারুফা আর্তনাদ করতে করতে বলছিলো-‘আমার এ জীবন রেখে লাভ কি, আমি এই জীবন আর রাখবো না; আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলো আনিস’।

আদরের ছোট ছেলে আনিস প্রেমের সম্পর্ক করে বিয়ে করলেও পারিবারিকভাবে মেনে নেন বাবা আবু তাহের। স্বজনরাসহ ঘরের খাটে বসে অঝোঁরে কাঁদছিলেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, ‘১৭ দিনের মাথায় আমার মেয়ের মতো বউমাটা বিধবা হয়ে গেলো। আমি বউমাকে শান্তনা দেওয়ার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আল্লাহ কেন আমাকে এমন শাস্তি দিলো। আমি কোনভাবে বিষয়টি মানতে পারছি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল আনিস। সেখানে পূর্বের লেনদেন শেষ করে শুক্রবার আনিসের নতুন গাড়িতে উঠার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই এভাবে চলে গেলে ছেলেটা’।

বৃহস্পতিবার রাত ৮ টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার আরশিনগর ফিউচার পার্ক এন্ড রিসোর্ট সংলগ্ন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় তাদের। তাদের একজন আনিসুর রহমান।  শুক্রবার (২০ জুন) সকালে উপজেলার ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের রূপনগর টিলায় গিয়ে এমন দৃশ্যেও দেখা মিলে।

আনিস ছাড়াও নিহতরা হলেন মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের রূপনগর টিলার অলি আহম্মদ মাদবার বাড়ীর জিয়াউর রহমানের ছেলে রিয়াজ উদ্দিন (১৮), গনি আহম্মদের বাড়ীর দিদারুল আলমের ছেলে আরাফাত হোসেন (১৮)। আনিসুর রহমান বাড়ির অদূরের বিএসআরএম স্টিল মিল কারখানার ড্রাম ট্রাক চালক এবং অন্য দুই জন চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ ও রেল পুলিশের কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার রাতেই একসাথে জানাযা শেষে তাদের দাফন করা হয়েছে।

দেড় বছর বয়সে মা হারা আরাফাত বেড়ে উঠে নানীর কাছে জন্মের দেড় বছর বয়সে মাকে হারান আরাফাত। তার মা রোকসানা আক্তার দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের সময় মারা যায়। বাবা দিদারুল আলম কোন খোঁজখবর না নেওয়ায় নানী বিবি আমেনা কোলে-পিঠে করে মানুষ করেন আরাফাতকে। মেয়ের শেষ স্মৃতি একমাত্র নাতীকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বিবি আমেনা। আরাফাতের ঘরে প্রবেশ করতেই জ্ঞান ফিরে বিবি আমেনার। জ্ঞান ফিরতেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। আর নাতী আরাফাতকে খুঁজছিলেন।

কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, ‘আমার সাথে বিকেলে নাস্তা করে বাড়ী থেকে বের হলো নাতীটা। ১০ মিনিট পর শুনি আমার নাতী নাই হয়ে গেছে। ও আল্লাহ তুমি আমার সোনার চানটারে কেন নিয়া গেলা।’

মায়ের ওষুধ আনা হলো না রিয়াজের বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ছিল রিয়াজ। ছেলে চাকুরি করে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরাবে স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের। সেই স্বপ্ন মিনিষেই শেষ হয়ে গেল। মা রুজিনা আক্তার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে রিয়াজ যখন বাড়ী থেকে বের হচ্ছিল আমার জন্য ওষুধ আনার জন্য বলি। সেই ওষুধও আর আনা হলো না, ছেলে ফিরলো লাশ হয়ে। অতি আদরে ছেলেকে বড় করেছি। পাসপোর্ট করিয়ে ছেলেকে বিদেশ দিইনি কষ্ট হবে বলে, ড্রাইভিং শিখতে দিয়ে আবার সেখান থেকে নিয়ে এসেছি, দেখলাম ছেলে কেমনযানি দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার আদরের ধনকে আজরাইলের ভূমিকায় ট্রেন এসে কেড়ে নিয়ে গেলো।’

দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া রায়হান যা জানালোঃ
ট্রেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ৪ বন্ধুর একমাত্র বন্ধু রায়হান হোসেন। কি হয়েছিল সেইরাতে এমন প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। মুহুর্তে তার চোখ পানিতে চলচল করছিল। গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলো না।

একটু স্বাভাবিক হয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রামগামী রেললাইন ধরে আমরা বিএসআরএম কারখানার দিকে যাচ্ছিলাম বকেয়া বেতনের জন্য। স্বাভাবিকভাবে পূর্ব পাশের রেললাইন দিয়ে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ট্রেন যায়। তাই আমরা ট্রেন সামনে এলে দেখবো ভেবে রেললাইন ধরে হাঁটছি এরিমধ্যে বারবার ট্রেনের হর্ণ শুনলেও আমরা ভাবছিলাম পাশের পশ্চিম পাশের লেন দিয়ে ট্রেন আসছে। যখন ট্রেন কাছাকাছি চলে আসে তখন ট্রেনের ধাক্কায় আনিস, আরাফাত ও রিয়াজ রেললাইন থেকে ছিটকে পড়ে যায়। আমি তাদের থেকে কিছুটা সামনে ছিলাম। যখন পিছন দিক থেকে ট্রেন আসলো দুর্ঘটনা হবে বুঝতে পেরে আমি লাফ দিয়ে লাইনের বাইরে গিয়ে পড়ে প্রাণে রক্ষা পাই। কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে আমিও রক্ষা পেতাম না।’

আলীম

আরো পড়ুন  

×