ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

নবাবগঞ্জে ইতিহাসের সাক্ষী সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের ভাঙা মসজিদ

বিপ্লব ঘোষ, দোহার,নবাবগঞ্জ 

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২০ জুন ২০২৫

নবাবগঞ্জে ইতিহাসের সাক্ষী সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের ভাঙা মসজিদ

দৈনিক জনকণ্ঠ

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় ৪শ’ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত ভাঙা মসজিদ।

উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নতুন বান্দুরা গ্রামের। গ্রামটি তিনদিকে নদী বেষ্টিত। সেই গ্রামেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে নতুন শাহী মসজিদ। যা ভাঙা মসজিদ নামে পরিচিত। প্রায় ৫০ শতাংশ জমির উপর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান। এর মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ জমির উপর রয়েছে মূল ভবনটি। 

প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে নবাবগঞ্জ, দোহার, কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ সদর,  সিংগাইর, হরিরামপুর, ঘিওর সহ আশেপাশের কয়েকটি থানার কয়েক হাজার নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নামাজের জন্য রয়েছে আলাদা সুব্যবস্থা।

মসজিদের সৌন্দর্য বুদ্ধির জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ১৬৫ ফুট সুউচ্চ একটি মিনার। মিনারটি ঢাকা দক্ষিণের সবচেয়ে বড় মিনার বলে জানা যায়।মসজিদটি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কল্পকাহিনি প্রচার করা হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে মসজিদটি গায়েবি। মূল ভবনটি মাটির নিচে থেকে উঠেছে।

মসজিদে নামাজ পড়ে কোনো কিছু মানত করলে আল্লাহর রহমতে সেই আশা পূরণ হয় বলে জানান আগতরা। সেই বিশ্বাসেই দিন দিন মসজিদে আগতদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।এলাকার মুরুব্বিরা জানান, তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত।

১৬১০ সালে ভারতবর্ষের মোঘল বংশের দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ছিলেন ইসলাম খান চিশতি। ইসলাম খান বিভিন্ন প্রয়োজনে দিল্লি থেকে যমুনা নদী দিয়ে নৌবিহার নিয়ে পাবনা হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জ হয়ে নবাবগঞ্জের ইছামতি নদী দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতেন।

সেই সময় রাতযাপন ও ইবাদত করার জন্য আনুমানিক ১৬১৬ সালে নদীর পাশেই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সেই হিসেবে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরোনো মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। 

তবে কালের বিবর্তনে ইছামতি নদী ভাঙতে ভাঙতে উত্তর দিকে চলে যায়। তখন মসজিদের পাশে কোনো বসতি ছিল না। পুরো এলাকাই ছিল বনাঞ্চল। ১৮৮০ সালে হিন্দু জমিদাররা এসব বনাঞ্চল পত্তন নেন। তখন সেখানে হিন্দুরা বসতি স্থাপন করার জন্য বনাঞ্চল কাটা আরম্ভ করেন।

বন কাটার সময় হঠাৎ দেখতে পান একটি মসজিদ। যার উপরের কিছু অংশ ভাঙা। তখন থেকে এ মসজিদের নাম হয় ভাঙ্গা মসজিদ বা গায়েবি মসজিদ। সে সময় সেখানে মসজিদ নির্মাণের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি পাওয়া যায়। তবে সময়ের সাথে সাথে সেগুলো হারিয়ে গেছে। 

মুরুব্বিরা জানান, পরবর্তীতে মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন স্থানীয় আলফু ফকির, দুদু মীর, আবেদালী মীর, গোপাল মাদবর, মৈজদ্দিন সিকদার, গহের আলী খন্দকারসহ স্থানীয়রা। সে সময়ে আবু মোল্লাকে মসজিদের মোতাওয়াল্লি বা সেবক নিযুক্ত করা হয়। সিএস রেকর্ডে মসজিদের পক্ষে তার নাম রয়েছে। ১৯৪৫ সালে স্থানীয় আবেদ্য আলী নিজ অর্থায়নে কিছু অংশ সংস্কার করেন। তখন মসজিদের সেবক হিসেবে দুখাই বেপারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৬০ সালে নতুন বান্দুরা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে আছেন আবজাল হোসেন নামে এক ধর্মপ্রাণ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি গ্রামবাসীকে নিয়ে ভাঙ্গা মসজিদটির কিছু অংশ মেরামত এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করেন।

কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয় ডা. আলমাছ উদ্দিন। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মকবুল ব্যাপারী ও শওকত আলিকে কোশাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কমিটি প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮০ সালে স্থানীয় আমজাদ হোসেন মাদবর গ্রামবাসীকে নিয়ে মসজিদের নতুন কমিটি ঘোষণা দিয়ে দায়িত্ব বুঝে নেন।

দায়িত্ব নেওয়ার পরই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। তখন মূল ভবনের সংস্কার করলেও তার অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। দীর্ঘসময় মসজিদের সেবক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত সামসুদ্দিন মুন্সি।

পরবর্তীতে আমজাদ হোসেন মাদবরের ছোট ছেলে কুয়েত প্রবাসী নজরুল ইসলামের প্রচেষ্টায় প্রবাসীদের অর্থায়নে মসজিদ সংলগ্ন আরেকটি ভবন তৈরি করা হয়।

২০০১ সালে মীর সফিউদ্দিন ও জনাব আলী সিকদারকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখে খন্দকার ফরহাদ হোসেনকে সভাপতি, মতিয়ার রহমানকে সাধারণ সম্পাদক ও ফজলুর রহমানকে কোশাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।

নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর এলাকাবাসী নিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি মিনার নির্মাণের পদক্ষেপ নেন। কিছুদিন কাজ করার পর মিস্ত্রি ও অন্য অসুবিধার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১১ সালের ৪ মার্চ পুনরায় মিনারের কাজ আরম্ভ হয়। ১৬৫ ফুট উঁচু মিনারটির কাজ শেষ হয়েছে ইতিমধ্যে। 

মসজিদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলন, ‘মানুষ আল্লাহর উপর বিশ্বাস করেই ভাঙ্গা মসজিদে আসেন ইবাদত করতে। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার কয়েক হাজার মানুষের আগমন ঘটে এ মসজিদে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি তাদের সহযোগিতা করতে।’

মসজিদের বর্তমান ইমাম মুফতি জোবায়ের হোসেন বলেন, প্রতিদিনই মসজিদে মুসল্লিদের ভীর থাকে। তবে শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায়ের আগে মসজিদের আশেপাশে মুসল্লিদের তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। কোথা থেকে এ মুসল্লিরা আসেন আবার নামাজ শেষে চলে যান। মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
 

হ্যাপী

আরো পড়ুন  

×