ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শেরপুরের গারো পাহাড়ে হাতির হানা: পর্যটনের উত্তাপ, বনবাসীর দীর্ঘশ্বাস

আতিয়া ইবনাত রিফাহ্, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ১২ জুন ২০২৫

শেরপুরের গারো পাহাড়ে হাতির হানা: পর্যটনের উত্তাপ, বনবাসীর দীর্ঘশ্বাস

ছবি: সংগৃহীত

গারো পাহাড় বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই পাহাড় শুধু পর্যটনের সম্ভাবনাই নয়, বরং বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। একসময় এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গারো পাহাড় ও এর পাদদেশে বাস করা মানুষ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি—“বন্যহাতির আক্রমণ।”

বন্যহাতির আক্রমণ: ভয়, ক্ষয় ও মৃত্যু

শেরপুরে বন্যহাতির আক্রমণ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি এক প্রাত্যহিক আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর ফসল তোলার মৌসুমে, বিশেষ করে ধান ও ভুট্টার মতো শস্য যখন পাকতে শুরু করে, ঠিক তখনই সীমান্তের ওপারের ভারতীয় বনাঞ্চল থেকে বন্যহাতির দল নেমে আসে লোকালয়ে। দিনের পর দিন পাহাড়বাসী রাতভর পাহারা দেয়, আতশবাজি ফাটায়, বাঁশি বাজায়, আগুন জ্বালে—তবুও হাতিরা থামে না। বরং দেখা যাচ্ছে, এই প্রাণীগুলো মানুষের এসব কৌশলে এখন আর ভয় পায় না, বরং আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।

গত এক দশকে এই অঞ্চলে বন্যহাতির আক্রমণে নারী ও শিশুসহ অন্তত ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় রয়েছে শতাধিক ভেঙে পড়া বাড়ি, পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের ক্ষেত এবং পশুসম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি। ২০১৬ সালে চিতাবাঘের থাবায় একজন পৌর মেয়র আহত হওয়ার ঘটনাও বনাঞ্চলের প্রাণীদের লোকালয়মুখী প্রবণতার ভয়াবহতা স্পষ্ট করে তোলে। এটি শুধুই বনজ সংকট নয়, এটি মানবিক নিরাপত্তার সংকটও বটে।

সংকটের উৎস: প্রকৃতি, মানুষ ও নীতির টানাপোড়েন

বন্যহাতির লোকালয়ে ঢুকে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া। গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন উজাড় করে সেখানে একাশি ও আকাশমণির মতো নিষিদ্ধ, দ্রুতবর্ধনশীল কিন্তু হাতির খাদ্যচক্রের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক গাছ লাগানো হয়েছে। এর ফলে হাতির চলাচলের ঐতিহ্যবাহী পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের নামে নির্বিচারে অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তা তৈরি এবং অরণ্যের গভীরে মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ার ফলে হাতিরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গজনী অবকাশ কিংবা মধুটিলা ইকোপার্কের সম্প্রসারণে আদিবাসীদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় স্থানীয় প্রকৃতি, পরিবেশ ও হাতির স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র হুমকির মুখে পড়েছে।

আরেকটি বড় সংকট হলো এই অঞ্চলের আন্তর্জাতিক সীমান্ত-ঘেঁষা অবস্থান। ভারত থেকে হাতিরা অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও দুই দেশের মধ্যে কোনো কার্যকর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বা হাতি করিডোর পরিকল্পনা নেই। এতে হাতিদের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের পথপ্রাপ্তি ব্যাহত হয়েছে, ফলে তারা জনবসতিপূর্ণ এলাকায় চলে আসছে।

যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের গল্প শোনে না কেউ

এই সংকটের প্রধান ভুক্তভোগী পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী উপজাতি জনগোষ্ঠী ও সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ। তারা বহু বছর ধরে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে, কৃষিকাজ বা বননির্ভর জীবিকায় নিজেদের জীবনযাপন গড়ে তুলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আলো থেকে তারা বরাবরই বঞ্চিত। হাতির আক্রমণে ঘর হারানো, ফসলের ক্ষতি কিংবা প্রাণহানির পর তাদের হাতে থাকে না কোনো ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের আশ্বাস।

অনেকেই ঋণ করে জমিতে ফসল ফলায়, যা হাতির আক্রমণে এক রাতে নষ্ট হয়ে গেলে এসব ঋণগ্রস্ত মানুষের সারা বছরের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। শিশুদের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়, কারণ নিরাপত্তাহীনতার কারণে অভিভাবকেরা তাদের স্কুলে পাঠাতে চান না। এসব এলাকায় নেই মানসম্মত স্কুল, নেই নিয়মিত চিকিৎসাসেবা। অর্থাৎ, তারা প্রকৃত অর্থেই রাষ্ট্রের দৃষ্টিসীমার বাইরে।

সমাধানের পথ: সহাবস্থানের সন্ধানে

এই সংকট থেকে উত্তরণ শুধু প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থায় সম্ভব নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও গবেষণাভিত্তিক সমাধান। প্রথমত, গারো পাহাড়ে পরিবেশবান্ধব বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশবিদ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের মতে, একাশি ও আকাশমণির মতো নিষিদ্ধ গাছ কেটে হাতির উপযোগী বন ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে হাতির ঐতিহ্যবাহী চলাচলের করিডোরগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। এসব করিডোরে যেকোনো ধরনের নির্মাণ, রাস্তা বা পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, হাতিরা কেন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে—এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে গবেষণার মাধ্যমে। তাদের খাদ্যচক্র, প্রজনন, স্থানচ্যুতি এবং আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা ছাড়া কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এটি কোনো স্থানীয় সমস্যার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি আন্তঃদেশীয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ।

তৃতীয়ত, পাহাড়পাদদেশের অধিবাসীদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। হস্তশিল্প, বনজ পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, ইকো-ট্যুরিজমে অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে তাদের জীবিকাকে সহনশীল করতে হবে। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে হাতি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী বনবিভাগের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে একটি আন্তঃসীমান্ত করিডোর ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে এই সংকট অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব হবে।

সবশেষে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিট ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা শুধু বেঁচে থাকাই নয়, সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেও পারে।

শেরপুরের গারো পাহাড় শুধু ভূগোলগত একটি এলাকা নয়; এটি একটি সংস্কৃতি, একটি জীববৈচিত্র্য, একটি মানবিক ইতিহাস। মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান সেখানে আগে ছিল, আজও থাকতে পারে—যদি রাষ্ট্র ও সমাজ সঠিকভাবে দায়িত্ব নেয়। পর্যটনের নামে পরিবেশ ধ্বংস, উন্নয়নের নামে বনজ সম্পদের অপব্যবহার এবং পরিকল্পনাহীন নীতিনির্ধারণ আমাদের সামনে যে ভয়াবহ বাস্তবতা হাজির করছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ আর নেই।

গারো পাহাড় থাকবে ঠিকই, কিন্তু তার প্রাণ যদি হারিয়ে যায়—তাহলে আমরা হারাব আমাদের উত্তরাধিকারের এক অমূল্য অংশ। তাই এখনই সময়, গবেষণা, সচেতনতা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করার।

মুমু ২

×