ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঈদ ফিরল, কিন্তু ফিরল না ছেলেরা

আপেল মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ৭ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৯:৫৫, ৭ জুন ২০২৫

ঈদ ফিরল, কিন্তু ফিরল না ছেলেরা

ঈদের সময়টাকে আমাদের দেশে বলা হয় ঘরে ফেরার মৌসুম। শহর ফাঁকা হয়ে যায়, আর গ্রাম ভরে ওঠে প্রাণে। ছোট-বড়, আত্মীয়-পরিজনের পদচারণায়। কিন্তু এবারের ঈদে ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক গ্রামের ঘরে নেই সেই চিরচেনা হাসিমুখ, নেই ব্যস্ততার আবহ। সন্তানরা ফিরছে না, টাকাও পাঠাতে পারছে না, শুধু ফিরে এসেছে নিঃসঙ্গ ঈদ।

ঠাকুরগাঁও সদরের  ঘনিমহেষপুর গ্রামের জরিনা বেগমের চোখে এই ঈদের রংটাই ধূসর। রোজার ঈদের পরে অনেক কষ্টে ছেলেকে কাজে পেয়েছিলেন। এবারের কুরবানির ঈদে শরিফুল ঢাকাতেই থেকে গেছে কাজের খোঁজে। জরিনার কণ্ঠে চাপা কষ্ট, “ঈদটা এখন আর আনন্দের না, যেন শুধুই প্রতীক্ষা আর হতাশা।”

ছেলে শরিফুল আগে ছিলেন ঢাকার মগবাজারে। করোনার সময় লকডাউনের শঙ্কায় ফিরেছিলেন গ্রামে। ভেবেছিলেন, এখানেই কিছু কাজ করে সংসার চালাবেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন। “চেষ্টা করেছিলাম এলাকায় কিছু করতে, কিন্তু সম্ভব হলো না। বছরখানেক আগে ঢাকায় ফিরে এসেছি আবার। এখন কাজ করছি, তবে টাকা পাঠাতে পারিনি। নিজেই খেয়ে না খেয়ে চলছি,” জানালেন শরিফুল।

রাজাগাঁও বাদিয়া মার্কেট গ্রামের আবুনুর রাশেদ আছেন সৌদি আরবে। শুক্রবার সেখানে ঈদের নামাজ পরে মা'কে ভিডিওো কল করেছিলেন। তিহি ভেবেছিলেন ঈদের আগে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে থেকে গেছেন সেখানে। মা রশিদা বেগম বলছিলেন, “ভিডিও কলে দেখলাম ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর যে খালি জায়গাটা আছে, সেটা তো আর ভরল না। দুই বছর হয়ে গেল ঈদের দিনটাতে ছেলেটা বাড়িতে নেই।”

শুধু দূর দেশের নয়, দেশের মধ্যেও ছেলেরা হারিয়ে গেছে কাজের পেছনে। আসাননগরের সাইদুল ইসলাম বিশ দিন আগে রওনা দিয়েছেন সিলেটের দিকে। ফোনে জানালেন, “জানতাম এবার ঈদে ফিরতে পারবো না। তবে অন্তত কিছু টাকা পাঠাতে পারব ভেবেছিলাম। তাও হচ্ছে না। যে কাজ জুটছে, তা দিয়েই নিজের থাকা-খাওয়া চলে। বাড়ির জন্য কিছু করতে পারছি না, এটা অনেক কষ্টের।”

ঘনিমহেষপুর গ্রামের আরেক শ্রমিক সাগর আলী, যিনি প্রতিবছর কুরবানির ঈদে ফিরতেন, এবার ফিরতে পারছেন না। তার বিধবা মা আজেদা বেগম বললেন, “এই দিনটাতে অন্তত ছেলেটা থাকত। এবার সে-ও বাইরে। ঈদের দিনে বাড়িতে ছেলের অভাবটা গলা চেপে বসেছে।”

রাজাগাঁওের এক প্রবাসী শ্রমিকের স্ত্রী কাঁপা গলায় বলছিলেন, “ঈদের দিনে বাচ্চারা যখন বলে, ‘বাবা কবে আসবে?’ তখন আমি চুপ করে যাই। এখন শুধু মনে হয়, ঈদের দিনটা তাড়াতাড়ি চলে যাক। কষ্ট তো সহ্য করতেই শিখে গেছি, কিন্তু এই শূন্যতা যেন সহ্য হয় না।”

প্রতিটি ঈদ একেকটি পরিবারের হাসিমুখ হওয়ার কথা। অথচ এবার সেই হাসির জায়গা নিয়েছে নিঃসঙ্গতা, প্রতীক্ষা আর জীবিকার কাছে পরাজয়ের যন্ত্রণা। শুধু ঘরে না ফেরা নয়, টাকা না পাঠানোর যন্ত্রণাও যেন সমান। কাজ না থাকায় শ্রমিকেরা নিজেই টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন, পরিবারকে কিছু দেওয়ার সুযোগই নেই।

হয়তো এবারের ঈদ হাজারো শ্রমিক পরিবারকে শেখালো, জীবিকার কাছে কতোটা অসহায় হতে পারে একজন মানুষ, তার মা, স্ত্রী, কিংবা সন্তান। ঈদের খুশির ভিড়ে হারিয়ে গেলো তাদের গল্প, যারা ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় কিংবা প্রবাসের ঘরবন্দি জীবনে রয়ে গেলেন একাকী।

তবে আশা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। কেউ কেউ এখনো প্রার্থনা করছেন, “হয়তো আগামী ঈদে ছেলেটা আসবে, মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরবে, হয়তো আবার হাসবে বাড়িটা...”

আঁখি

×