ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুই বছরেও হয়নি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ৭২টি বিদ্যালয়ের ১০,৭৩৫ জন শিক্ষার্থী

মোস্তাক আহমেদ বাবু, পীরগাছা (রংপুর)।

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ৩০ মে ২০২৫; আপডেট: ২২:১২, ৩০ মে ২০২৫

দুই বছরেও হয়নি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ৭২টি বিদ্যালয়ের ১০,৭৩৫ জন শিক্ষার্থী

ছবি:সংগৃহীত

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে ৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধুনিক শৌচাগার (ওয়াশ ব্লক) নির্মাণকাজের ৪২টি শৌচাগার নির্মাণ কাজ দুই বছরেও শেষ হয়নি। এর মধ্যে ৩০টি বিদ্যালয়ে শৌচাগার নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এখনো উদ্বোধন হয়নি।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচির (পিইডিপি-৩) আওতায় উপজেলার ৭২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আধুনিক শৌচাগার নির্মাণের কাজ চলছে। ১০টি ঠিকাদারি সংস্থা এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে। প্রতিটি শৌচাগার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা করে। ৭২টি শৌচাগার নির্মাণে সর্বমোট প্রায় ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ২০২৩/২০২৪ অর্থবছরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কার্যাদেশ মোতাবেক ৩৬৫ দিনে এসব শৌচাগারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস পরেও নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। এতে হাত ধোয়া, শৌচাগার ব্যবহার ও বিশুদ্ধ পানি পানে ভোগান্তিতে পড়েছে এসব বিদ্যালয়ের প্রায় ১০,৭৩৫ জন শিক্ষার্থী।

নির্মাণকাজে ঠিকাদারের ধীরগতি এবং উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাফিলতি ও তদারকির অভাবে এসব বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না, বলে অভিযোগ করছেন বিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকবৃন্দ।

সম্প্রতি উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের প্রতাপ বিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ওয়াশ ব্লকের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। ওয়ালে টাইলস লাগানো হয়নি, শৌচাগারে প্যান ও হাত ধোয়ার বেসিন এখনো বসানো হয়নি। এই বিদ্যালয়ে পানির পাম্প থাকলেও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। সেখানকার একমাত্র নলকূপটিও বিকল হয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ে একটি ইটের পুরোনো শৌচাগার থাকলেও সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। কারণ সেটিতেও ফাটল ধরেছে, যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে প্রতাপ বিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল কুদ্দুস জানান, নির্দিষ্ট সময়ে শৌচাগার নির্মাণ না করায় এখন নিরুপায় হয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা পাশের এক বাড়িতে শৌচকর্ম সারছেন।

একই ইউনিয়নের হরিচরণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শৌচাগারের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ছাদ ঢালাই ফিনিশিং হয়নি। সেখানেও প্যান ও বেসিন বসানোর কাজ বাকি। শৌচাগারে এখন গরু-ছাগলের বসবাস। কিছুদিন আগে কাজ শেষ হলেও ছাদ থেকে পানি চুয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। অভিযোগ রয়েছে রাতের বেলা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে শৌচাগারের ছাদ ঢালাই করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক হাসনা বেগম অভিযোগ করে বলেন, প্রায় এক বছর আগে থেকে ঠিকাদার কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই কাজের ঠিকাদারকে আমি চিনি না। এমনকি কোনোদিন তাঁকে দেখিওনি, শুধু শ্রমিকরাই কাজ করেছেন। শ্রমিকেরা তাদের ইচ্ছেমতো নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করেছেন। এসব নিয়ে অভিযোগ করলে শ্রমিকেরা কাজ ফেলে চলে যান। প্রামানিক এন্টারপ্রাইজ যে ঠিকাদার এ কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি শাফায়েত জামিল নামের এক ব্যক্তির কাছে কাজগুলো বিক্রি করেছেন। এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রীমতি ছবি রানী বলেন, নির্মাণকাজ খুবই নিম্নমানের হয়েছে। এমনকি কাজ শেষ না হতেই ছাদ যেন ঢেউ খেলছে। এ নিয়ে ঠিকাদার মোঃ শাফায়েত জামিলের ব্যবহৃত মোবাইলে ফোন দিলে, ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়, ফলে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী তথ্য মতে প্রামানিক এন্টারপ্রাইজ ১০টি ওয়াশ ব্লকের কাজ পেয়েছে বলে জানা যায়।

উপজেলার একই ইউনিয়নের পঞ্চানন মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগারের অবস্থাও একই রকম। এই বিদ্যালয়সহ দশটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লকের কাজ পেয়েছে হাবিব কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লিটন নামের এক ব্যক্তির নিকট কাজগুলো বিক্রি করেছেন। তিনি আবার রবিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির নিকট কাজগুলো বিক্রি করেছেন। এই বিদ্যালয়সহ ১০টি বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণের কাজ পেয়েছিল ওই প্রতিষ্ঠান। রবিউল ইসলাম বলেন, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করা হবে। কাজের মান নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিব কনস্ট্রাকশনের ঠিকাদার হেলাল উদ্দিন কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দেন।

২০২৩/২০২৪ অর্থবছরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কার্যাদেশ মোতাবেক ৩৬৫ দিনের মধ্যে এসব শৌচাগারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ছয় মাসের বেশি সময় পার হলেও একটি শৌচাগারের কাজও শতভাগ শেষ হয়নি। কোনটি ৯০ ভাগ, কোনটি ৫০ ভাগ, কোনটি ৪০ ভাগ কাজ করে ঠিকাদার কাজ রেখে চলে যান। এ নিয়ে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লিটনকে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন দিলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

পীরগাছা উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ আবুল হোসেন বলেন, ৭২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩০টি বিদ্যালয়ের শৌচাগার (ওয়াশ ব্লক) এর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বাকি ৪২টি ওয়াশ ব্লকের ৪০ ভাগ কাজ করে ঠিকাদার চলে গেছে। এক বছর ধরে ঠিকাদারের আর কোনো খোঁজ নেই। ঠিকাদারকে ফোন করলে নানা আশ্বাস দিয়ে ফোন কেটে দেন। জনস্বাস্থ্যের ইঞ্জিনিয়ারকে বারবার তাগাদা দিয়েছি। তিনি আমার কথা কানে তোলেননি। তাদের তদারকির অভাবে ঠিকাদাররা নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করেনি।

পীরগাছা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ সানোয়ার মোর্শেদ মোবাইলে বলেন, ঠিকাদারদের দ্রুত কাজ শেষ করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৪২টি বিদ্যালয়ের কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করার কারণে সরকারি বিধি মোতাবেক দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। বাকি ঠিকাদারদেরও জরিমানার আওতায় আনা হবে বলে জানান।
 

মারিয়া

×