ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

লিচুর রাজধানী ঈশ্বরদীতে ফলনে ধস ! প্রতিষ্ঠিত লিচু চাষী কিতাব আলী মণ্ডলও ক্ষতির শিকার

স্টাফ রিপোর্টার, ,ঈশ্বরদী

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ২৯ মে ২০২৫; আপডেট: ১৮:১৯, ২৯ মে ২০২৫

লিচুর রাজধানী ঈশ্বরদীতে ফলনে ধস ! প্রতিষ্ঠিত লিচু চাষী কিতাব আলী মণ্ডলও ক্ষতির শিকার

ছবি:জনকণ্ঠ

ঈশ্বরদীর মিরকামারী গ্রামের আজকের প্রতিষ্ঠিত লিচুচাষী কিতাব  আলী মণ্ডল ১৯৮৪ সালে যখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তখন থেকেই তাঁর মনে লিচু ও কাঁঠাল চাষ করে অর্থ আয় সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হতো। ১৯৮৪ সালে প্রথমে তিনি এক বিঘা জমিতে ১০টি লিচু গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে লিচু চাষের যাত্রা শুরু করেন।

 

 

পরবর্তীতে একটি একটি করে ৩শ' গাছবিশিষ্ট ৬টি বড় লিচুবাগান তৈরি করেন। এসব বাগানে প্রতিবছরই প্রচুর লিচুর ফলন হলে কিতাব আলী আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে  বোম্বাই ও দেশী লিচু চাষ শুরু করেন। লিচুর বাম্পার ফলন প্রচুর অর্থ আয় ও দেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় লিচু ব্যবসায়ীর আসা-যাওয়া শুরু হয় ঈশ্বরদীর চরমিরকামারী গ্রামে। বিষয়টি গ্রামের পর গ্রামে এমনকি এক সময় ছলিমপুর ইউনিয়নব্যাপী মানুষের মধ্যে লিচু চাষের আগ্রহ সৃষ্টি করে। বর্তমানে এই ইউনিয়নে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে 8 হাজার চাষী ১২ হাজার বাগানে লিচুচাষের সাথে জড়িত রয়েছে। এ বছর চলতি মৌসুমে চরমিরকামারী গ্রামসহ ছলিমপুর ইউনিয়নেই শুধু ৫০/৬০কোটি টাকার লিচুর ফলন হয়েছেন।

 

এর মধ্যে কিতাব আলী মণ্ডল বারোটি বাগানের  ১ হাজারটি গাছের লিচু অগ্রিম বিক্রি করে মোটা অঙ্কের লোকসান হবে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে লিচু গাছে মুকুল আসার সাথে সাথেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, যশোর অঞ্চলের ব্যবসায়ীর। বাগান ধরে অগ্রিম ভিত্তিতে কিনে নেন। পরবর্তীতে জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই ওই ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের মাধ্যমে গাছ থেকে লিচু ছাড়িয়ে স্ব-স্ব এলাকায় নিয়ে বিক্রি করেন। এ বছরও একইভাবে ওইসব ব্যবসায়ীরা শিমুলতলা, আওতাপাড়া থেকে প্রতিদিন ১৯/২০ ট্রাক, বাসের ছাদে করে লিচু স্ব-স্ব এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ১২ হাজার বাগানে ৩০হাজার  শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে শ্রম দিচ্ছে। লিচুর রাজধানী বলে খ্যাত ঈশ্বরদীতে উঠতে শুরু করেছে রসালো ও মিষ্ট বোম্বাই লিচু। ফলন বিপর্যয়ের কারণে এবারে চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বোম্বাই লিচু। ফজর নামাজের পর হতে জয়নগরের শিমুলতলা, দাশুড়িয়া ও আওতাপাড়া হাটে বিক্রি শুরু হয়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে লিচু বেচা-কেনা। কিন্তু এবারে সকাল ৭টার আগেই লিচু কেনা-বেচা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন বাগান থেকেও ব্যাপারীরা আগেভাগে লিচু ভাঙতে শুরু করেছেন। ঈশ্বরদীর লিচুর দেড় জুড়ে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দেশের মধ্যে ঈশ্বরদীতে সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপন্ন হয়। সে কারণে ঈশ্বরদীকে লিচুর রাজধানী বলা হয়। ঈশ্বরদীতে সুস্বাদু ও বিখ্যাত বোম্বাই লিচু বেশি উৎপাদন হয়। ঈশ্বরদীর উৎপাদিত লিচু দিয়ে দেশে মানুষের লিচুর চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এবারে অধিকাংশ গাছে মুকুলের পরিবর্তে নতুন পাতা বেশি আসায় ফলনে ধ্বস নেমেছে। ঈশ্বরদীতে ৩,১০০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে ১২ হাজার ৩৬০টি। গাছ রয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার। মুকুল পরিপূর্ণ প্রতি গাছে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার লিচু ধরে। উপজেলার ছলিমপুর, সাহাপুর, পাকশী, দাশুড়িয়া, মুলাডুলি ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় শত শত বাগান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি লিচু বাগান রয়েছে ছলিমপুর ও সাহাপুর ইউনিয়নে। ঈশ্বরদীতে মোজাফফর (দেশী) ও বোম্বাই জাতের লিচুর আবাদ হয় বেশি। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদীতে গত বছর ৩০ হাজার মেট্রিক টন লিচুর ফলন হয়েছিল। বিক্রয় মূল্য ছিল ৩৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরও আগের বছর লিচু উৎপাদন হয় ২৭ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। বাজার মূল্য ছিল ৪১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এবারে তার ভিন্ন চিত্র। জলবায়ুর প্রভাবে পরাগায়ণ না হওয়ায় গাছে মুকুল কম এসেছে। এবারে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। গতবছরের চেয়ে ১০ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন কম। এবারে লিচুর বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ২২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

 


জলবায়ুর প্রভাবে আবহাওয়ার তারতম্য হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে লিচুর মুকুল আসার প্রাক্কালে হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টির কারণে গাছে মুকুল বের না হয়ে বেশিরভাগ গাছে এসেছে নতুন কচি পাতা। এ কারণে ঈশ্বরদীতে এবার লিচুর ফলন বিপর্যয় হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ ও লিচু চাষিদের সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।
ঈশ্বরদীতে বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষির সংখ্যা ২১ হাজার। এ ছাড়াও ছোট-বড় বাগান ও বাড়ির আঙিনায় লিচু গাছ রয়েছে। লিচুর পরিচর্যা, বিপণন ও বাণিজ্যিককরণসহ আরও প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ লিচু সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতো। কোনো কাজ না থাকায় কিন্তু এবারে তারা হতাশ বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।
বৃহস্পতি বার (২৯ মে) জয়নগরের শিমুলতলা মোকামের আড়তদার আলম হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগে ফলন কম এবং খরায় লিচু ঝরে পড়েছিল। কিন্তু এবছরের মতো ফলন বিপর্যয়  আগে কখনো হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে যা লিচু আছে তা শেষ হয়ে যাবে। অন্যান্য বছরে ৪০০- ৫০০ কোটি টাকার মতো লিচু কেনা-বেচা হলেও এবারে ধ্বস নেমেছে।
জয়নগর শিমুলতলা হাটে লিচু বিক্রি করতে আসা বরিশালের ব্যপারী রহমত তালুকদার বলেন, হাটে লিচু কম, মানও ভালো না, আবার দামও দ্বিগুণ। বিক্রেতা শামসুল আলম জানান, ৩০টি গাছের মধ্যে ৭টি গাছে কিছু বোম্বাই লিচু ধরেছে। এবছর লিচু কম আশায গাছের যত্ন নেওয়া হয়নি। তাই লিচু ভালো হয়নি। কিছু লিচু বিক্রি করার জন্য এসেছি। লিচু কম হওয়ায় লিচুর দাম এবারে প্রায় দ্বিগুণ। গতবারে পাইকারীতে লিচু ২,০০০ থেকে ২,৫০০ হাজার দরে বিক্রি করেছি। এবারে ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

 


ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার জানান, ঈশ্বরদীর লিচু বাগানের গাছে গতবারের তুলনায় এবার মুকুল কম এসেছে। লিচুর ফলন বিপর্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, মুকুল আসার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে বৃষ্টি হয়। অসময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় মুকুলের পরিবর্তে অধিকাংশ গাছে নতুন কচি পাতা এসেছে। একারণে কিছুটা ফলন বিপর্যয় হয়েছে। বিগত বছর হেক্টর প্রতি ৯ মেট্রিক টন লিচু হলেও এবারে ফলন হয়েছে ৬ মেট্রিক টনের কম। ফলন কমে যাওয়ায় হাট-বাজারে লিচুর সরবরাহ কমেছে।

আঁখি

×