
মেলখুম
রহস্যঘেরা প্রাকৃতিক রত্ন হয়ে উঠেছে মিরসরাইয়ের মেলখুম ট্রেইল, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই প্রতিদিন ছুটে আসছেন শত শত পর্যটক।
সাখাওয়াত সাকিব, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) থেকে—
সবুজ পাহাড় আর ঝিরিঝিরি ঝরনার শব্দ। গায়ে মাখা ঠান্ডা বাতাস আর পায়ের নিচে পিচ্ছিল পাথর। সামনে এগোতেই দেখা মিলছে গভীর বনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঝিরিপথ। ঠিক যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো জাদুর জগত—এটাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মেলখুম ট্রেইল।
সরু পাহাড়ি পথ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই স্থানটি। অথচ সরকারি বিধিনিষেধ অনুযায়ী, এটি একটি নিষিদ্ধ এলাকা। বন বিভাগের অনুমতি ছাড়াই সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও প্রতিদিনই নানা বয়সী মানুষ ছুটে যাচ্ছেন রোমাঞ্চ আর রহস্যের খোঁজে।
মিরসরাইয়ে ছোট-বড় বহু ঝরনা থাকলেও, মেলখুম যেন একটু ভিন্ন। এখানে শুধু ঝরনাই নয়, আছে দীর্ঘ ঝিরিপথ, দুর্গম খাড়া পাহাড়, গভীর অরণ্য আর নিঃসঙ্গ নির্জনতা।
স্থানীয় দুই তরুণ মাঈনউদ্দিন শুভ ও সাখাওয়াত কয়েক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেলখুমের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করলে জায়গাটি আলোচনায় আসে। এরপর থেকেই পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে।
মেলখুম পৌঁছাতে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দুর্গম ট্রেইল। পাথরের ওপর দিয়ে ছুটে চলা জলধারা, খাড়া ঢাল আর বাঁকে বাঁকে পাহাড়ি বাঁশ ও লতা-গুল্মে ঢাকা পথ—সব মিলে এটি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই বিপজ্জনক।
স্থানীয় দোকানদার হোরা মিয়া বলেন,
"গত বছর এত লোক আসেনি। এবার প্রচুর মানুষ আসছে। আমাদের দোকানে বিক্রিও বেড়েছে।"
তবে শুধু বিক্রি বাড়া নয়, চিন্তাও বেড়েছে। কারণ, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই।
পর্যটকদের কেউ কেউ পথ হারিয়ে ফেলেন। গত কয়েক মাসে একাধিকবার ৯৯৯-এ ফোন করে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অনেক সময় উদ্ধার অভিযানে পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসকেও যুক্ত হতে হয়েছে।
ফিরে আসা কিছু পর্যটক জানান, তারা নাকি ঝিরিপথে অদৃশ্য কোনো ‘চাপ’ অনুভব করেছেন। কেউ বলেন, শরীরে অদ্ভুত দুর্বলতা দেখা দেয়। কেউ আবার এটাকে ‘জ্বিনের প্রভাব’ বলে ব্যাখ্যা করছেন।
যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘ হাঁটাহাঁটি, পানিশূন্যতা বা ভয় থেকেই এসব অনুভূতি হতে পারে।
মেলখুম ট্রেইল চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের রিজার্ভ বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ এটি সরকারিভাবে সংরক্ষিত বন, যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মিরসরাই রেঞ্জের বন কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ নওশাদ বলেন,
“পর্যটকরা নিয়ম না মেনেই প্রবেশ করছেন। আমরা নানা সময় সাইনবোর্ড, ব্যানার দিয়ে নিষেধ করছি। আমাদের বিট কর্মকর্তারা পাহাড়ে ওঠা বন্ধ করতে বলেন, কিন্তু পর্যটকরা শোনেন না।”
তবে সবার প্রশ্ন—শুধু নিষেধ করে কি সমাধান সম্ভব?
স্থানীয়রা বলছেন, মেলখুমকে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে এলাকার মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে, বাড়বে নিরাপত্তা ও পরিবেশের সুরক্ষাও।
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমিত প্রবেশাধিকার, নিবন্ধিত গাইড, দুর্গম ট্রেইলের নিরাপত্তা এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে এই জায়গাটি টেকসই পর্যটন গন্তব্য হতে পারে।
সানজানা