
বাংলাদেশের মানচিত্রে উত্তরের এক নিরব জনপদ ঠাকুরগাঁও। রংপুর বিভাগের একটি সীমান্তবর্তী জেলা হলেও এর পরিচিতি এখনও মূলধারার গণমাধ্যমে খুব একটা উঠে আসেনি। কিন্তু যে কেউ একবার এই জেলায় পা রাখলেই বুঝতে পারবেন—এখানে লুকিয়ে আছে এক বিপুল সম্ভাবনার গল্প। একদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ, অন্যদিকে মানবসম্পদ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঠাকুরগাঁওকে গড়ে তুলতে পারে দেশের একটি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কৃষি-ভিত্তিক কেন্দ্র হিসেবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তার কৃষি। জেলার প্রায় ৮০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। ধান, গম, আলু, ভুট্টা, সরিষা—সবই হয় এখানে। বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও সদর ও রানীশংকৈল উপজেলায় আলু চাষে এসেছে বিপ্লব। এখানে উৎপাদিত আলু দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
অন্যদিকে, লিচু, পেয়ারা, আম, কলা—এইসব মৌসুমি ফলের উৎপাদনেও ঠাকুরগাঁও এখন গুরুত্বপূর্ণ নাম। জেলার কৃষকেরা এখন কৃষিকে শুধু জীবনধারণের মাধ্যম নয়, বরং বাণিজ্যিক খাত হিসেবেও দেখছেন। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং জৈব চাষের উদ্যোগগুলোকে আরও বিস্তৃত করা হলে দেশের কৃষিতে ঠাকুরগাঁও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
ঠাকুরগাঁওয়ের একটি বড় সুবিধা এর ভৌগোলিক অবস্থান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত থাকার কারণে এখানে সীমান্ত বানিজ্যের বিশাল সুযোগ রয়েছে। হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় সীমান্ত হাট চালু করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে স্থানীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে কোল্ড স্টোরেজ, প্যাকেজিং ইউনিট, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এতে করে শুধু স্থানীয় কৃষকই উপকৃত হবেন না, জেলাটি হয়ে উঠবে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র।
ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে দর্শনীয় বহু স্থান। সালন্দর জমিদার বাড়ি, পীরগঞ্জের বটগাছ, রাণীশংকৈলের ‘নেকমরদ পীরের গড়’, টাঙ্গন নদীর পাড়, হরিপুরের উঁচু নিচু প্রাকৃতিক টিলাসমূহ, চৌগাছা ইকোপার্কসহ বহু সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। তবে প্রয়োজন উপযুক্ত অবকাঠামো, হোটেল-মোটেল, ও ব্র্যান্ডিং।
লোকজ সংস্কৃতি, নাচ-গান, পিঠা উৎসব, এবং ঐতিহ্যবাহী পালাগান ঠাকুরগাঁওকে সাংস্কৃতিক পর্যটনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে নিতে পারে।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও একাধিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসছে দক্ষ মানবসম্পদ। কিন্তু এখনও তথ্য প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের মতো খাতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় তরুণদের মধ্যে স্টার্টআপ সংস্কৃতি গড়ে তুললে জেলা হয়ে উঠতে পারে আইটি ও ডিজিটাল কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তার আঁতুড়ঘর।এই জেলায় নারীরা শুধু গৃহস্থালির কাজেই সীমাবদ্ধ নন। তাঁরা আজ কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার, পোশাক তৈরির হস্তশিল্প, এমনকি অনলাইন ব্যবসাতেও জড়িত। ঠাকুরগাঁওয়ের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যদি সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে নারীদের মাধ্যমে এই জেলায় একটি শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে।
ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত রেলপথ বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া জেলা সদর থেকে উপজেলা পর্যায়ে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কাজ চলমান। আগামীতে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় আঞ্চলিক সংযোগ আরও উন্নত হলে জেলার অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃজেলা বানিজ্য এক নতুন গতিতে পৌঁছাবে।
যে ঠাকুরগাঁও একসময় ছিল কেবল এক নিরব প্রান্তিক জেলা, সেই জেলাই আজ ক্রমশ উঠে আসছে সম্ভাবনার আলোয়। কৃষি, সীমান্ত বানিজ্য, পর্যটন, মানবসম্পদ—সব কিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে যদি একটি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ঠাকুরগাঁও শুধু রংপুর বিভাগ নয়, বরং গোটা উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই সম্ভাবনা আছে, তবে সেটা আবিষ্কার ও কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। ঠাকুরগাঁও সেই নিঃশব্দ সম্ভাবনার এক শক্ত ভিত, যা সময় ও পরিকল্পনার ছোঁয়ায় হয়ে উঠতে পারে “নতুন বাংলাদেশের নতুন গন্তব্য”।
রাজু