
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বালাপাড়ায় উত্তরবঙ্গ শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো যৌন নিপীড়ন ও করণীয় বিষয়ক এক সচেতনতামূলক সেমিনার। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজিত এই সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় সমাজকর্মীরা।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) বিকেল ৪ টায় উত্তরবঙ্গ শিশু উন্নয়ন প্রকল্প বালাপাড়ায় অডিটোরিয়ামে" যৌন নিপীড়ন ও করণীয় বিষয়ক এক সচেতনতামূলক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেহেদী হাসান মুরাদ—সামাজিক সংগঠক এবং ওয়ার্ল্ড চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফোরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “যৌন নিপীড়ন বলতে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং ডিজিটাল বা অনলাইন নিপীড়নও বোঝায়। অনেক সময় শিশুরা বুঝতেই পারে না যে তারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা বারবার বলছি—আপনার শরীর, আপনার অধিকার। কেউ যদি জোর করে, ভয়ের সৃষ্টি করে বা ফাঁদে ফেলে আপনার শরীরের ওপর কর্তৃত্ব নিতে চায়, সেটি স্পষ্টভাবে যৌন নিপীড়ন। সম্মতি ছাড়া কোনো স্পর্শ নয়—এটি আমাদের শিশুদের প্রথমেই শেখাতে হবে।”
সেমিনারে যৌন নিপীড়নের ধরন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যৌন নিপীড়নের প্রধানত তিনটি ধরন রয়েছে—শারীরিক, মানসিক এবং অনলাইন নিপীড়ন। অনেকে খেয়াল করে না, কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে হয়রানি এখন সবচেয়ে দ্রুত বিস্তৃত একটি সমস্যা। এমনকি শিশুরা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তখনও তাদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।”
তিনি স্পর্শের তিনটি ধরণ সম্পর্কে বলেন, “ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ এবং বিভ্রান্তিকর স্পর্শ—এই তিনটি স্পর্শের পার্থক্য শিশুকে বোঝানো গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পরিবারের মধ্যেও অনাকাঙ্ক্ষিত বা অস্বস্তিকর স্পর্শ হতে পারে, সেটিও খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে হবে।”
নিপীড়নের শিকার হলে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, “চুপ থাকলে সমস্যা বাড়ে। সাহস করে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বড় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে হেল্পলাইনে কল করতে হবে। আমরা সবাইকে জানাচ্ছি—১০৯, ১০৯৮ এবং ৯৯৯—এই তিনটি নম্বর মনে রাখুন। এগুলোতে ফোন করলেই মিলবে সহায়তা।”
সেমিনারের অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফোরামের চাইল্ড প্রটেকশন অফিসার কামরুননাহার তানি। তিনি বলেন, “অনেক শিশু নিপীড়নের শিকার হলেও ভয়, সংকোচ বা বিশ্বাসের অভাবে কারও সঙ্গে বিষয়টি ভাগাভাগি করতে পারে না। পরিবার, স্কুল এবং সমাজকে এমন একটি সহনশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে শিশুরা ভয়হীনভাবে নিজের কথা বলতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সমাজে এখনও অনেকে মনে করে শিশুদের এসব বিষয়ে সচেতন করার দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অপরাধীরা শিশুদের নীরবতাকেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে অপরাধের শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না।”
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মিঠাপুকুর বালাপাড়ার উত্তরবঙ্গ শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের ম্যানেজার জেমস সিমন সরকার। তিনি বলেন, “শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। শুধু এনজিও বা সরকারের একার পক্ষে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরকে এগিয়ে আসতে হবে।”
সেমিনার শেষে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তারা খোলামেলা প্রশ্ন করে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায়—সে বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে।
সেমিনারের সারাংশে বারবার উঠে আসে—সাহসই মূল চাবিকাঠি। বক্তারা বলেন, “আপনি সাহসী, আপনি সচেতন, আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন।”
মিরাজ খান