ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৭ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শতকোটি টাকার সবজি বিক্রি, নেই একটি ব্যাংকও!

আপেল মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ২৬ মে ২০২৫

শতকোটি টাকার সবজি বিক্রি, নেই একটি ব্যাংকও!

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়ন—সবজি উৎপাদনের একটি অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। অনেকে এটিকে সবজির রাজধানী হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন।

সদরের রুহিয়া থানাধীন এই এলাকায় বাঁধাকপি, টমেটো, কাঁচামরিচ, বেগুন, শসা, মুলা, লাউসহ নানা ধরনের কাঁচামাল প্রতিদিন এখান থেকে সরবরাহ হচ্ছে ঠাকুরগাঁও শহর, আশপাশের জেলা এমনকি রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চিটাগাংয়েও।

রাজাগাঁওয়ের পণ্যভাণ্ডার এতটাই সমৃদ্ধ যে ঢাকার কাওরান বাজার, জয়কালী বাজার ও শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা নিয়মিত আসেন এখান থেকে কাঁচামাল কিনে নিতে। কিন্তু এখানে অর্থনৈতিক লেনদেন হয় নগদ ভিত্তিতে। কারণ, এলাকায় নেই কোনো ব্যাংকের শাখা—যেখানে বৃহৎ লেনদেন নিরাপদভাবে করা অসম্ভব।

ঢাকাগামী আরদ্দার রকি পোদ্দার বলেন "আমরা বছরে কোটি টাকা নিয়ে এখানে আসি, অথচ আশপাশে কোনো ব্যাংক নেই। এটা আমাদের জন্যও নিরাপদ না, কৃষকদের জন্য তো নয়ই।"

এই ইউনিয়নে রয়েছে ১৫/২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজারো শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। আছে ৫টি সক্রিয় হাটবাজার, যেখানে প্রতিদিন লাখ টাকা মূল্যের বেচাকেনা হয়। তবু নেই কোনো ব্যাংকের শাখা বা উপশাখা। ফলে প্রতিটি আর্থিক কার্যক্রমের জন্য এলাকার মানুষকে ছুটতে হয় ঠাকুরগাঁও শহর কিংবা অন্য কোথাও।

রাজাগাঁওয়ের বহু পরিবার সরকারি বিভিন্ন ভাতা—বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা ইত্যাদি পান। কিন্তু ব্যাংক না থাকায় টাকা উত্তোলন করতে হয় দূরের ব্যাংকে গিয়ে বা এজেন্ট ব্যাংকিং-এর ভরসায়। এতে সময়, টাকা ও হয়রানি—সবই বাড়ছে।

স্থানীয় বিধবা ভাতা ভোগী রওশন আরা বেগম বলেন "ভাতা আসে, কিন্তু টাকা তুলতে হলে আমাকে অন্যের সহায়তা নিতে হয়। একা গেলে সম্ভব হয় না।"

রুহিয়া জনতা ব্যাংকে ভাতার টাকা তুলেন, আমজাদ হোসেন (৭০)। তিনি বলেন, "বাবা, মুই তো আগের মতন বেড়াবা পারু না। হামার বুড়া মানুষের কষ্ট তো কেহ বুঝে না। বাড়িতে ১০ কিলোমিটার দূরত ওসে টাকা তুলিতে যে কী কষ্ট হচে, ওইডা তুমাক বুঝবা পারিম নি। হামার ইউনিয়নত একটা ব্যাংক রহিলে এরং কষ্ট হলেহে নি।"

ব্যাংক না থাকায় নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের অর্থ সঞ্চয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গৃহবধূ শিউলি খাতুন বলেন, "আমরা যদি নিজের নামে সঞ্চয় রাখতে পারতাম, তাহলে ঘর থেকেই ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারতাম।"

তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্যও স্কলারশিপ, ফি প্রদান, আবেদন ফি জমা ইত্যাদির জন্য শহরে যেতে হচ্ছে, যা শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আবার যেসব পরিবার প্রবাসী  আত্মীয়ের রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল তাদের পরিবারকে রেমিট্যান্স পেতে শহরে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। সময় ও নিরাপত্তার ঝুঁকি তো আছেই, অনেক সময় ভুল তথ্য বা সীমিত এজেন্টের কারণে টাকা পেতে বিলম্ব ঘটে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বারবার দাবি জানানো হলেও স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। অথচ রাজাগাঁওয়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হলে পুরো এলাকার অর্থনীতিতে গতি আসবে। এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আর্থিক লেনদেনের জন্য নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক শাখা।

মোবাইল ব্যাংকিং আছে বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় এবং অনেক সময় লেনদেন সীমা, কমিশন ও নেটওয়ার্ক সমস্যায় কার্যকর থাকে না। ফলে শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত সবাইকেই শহরে ছুটতে হয়। এখানকার কৃষকরা প্রতিদিন উৎপাদন করছেন, কিন্তু নিজেদের লেনদেনের নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। 

স্থানীয় কৃষক শহিদ আলী বলেন "আমরা মাঠে কাজ করি, বাজারে বিক্রি করি। কিন্তু টাকা জমাতে হলে যেতে হয় রুহিয়া কিংবা ঠাকুরগাঁও শহরে। সারাদিন সময় নষ্ট হয়, সাথে বাড়ে খরচ আর ঝুঁকি।"

ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাবেয়া সুলতানা বলেন, বছরে হাজার কোটি টাকার সবজি বিক্রি হওয়া রাজাগাঁওয়ে ব্যাংকের কোনো শাখা না থাকায় কৃষকসহ শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ভাতাভোগীসহ ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একটি ব্যাংকের শাখা হলে এলাকায় আরো ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, সাধারণ মানুষও আর্থিক নিরাপত্তা পাবে।

রাজাগাও ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য লিপি আক্তার বলেন, রাজাগাঁও শুধু একটি ইউনিয়ন নয়, এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতির একটি মডেল। এখানে ব্যাংক না থাকা মানে উন্নয়নের বড় অন্তরায়। "ব্যাংক আসুক শহর থেকে গ্রামে—মানুষ হোক নিজের অর্থের মালিক"—এটাই আজকের দাবি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাইরুল ইসলাম বলেন, “এই বাজারের আর্থিক গুরুত্ব বিবেচনায় একটি ব্যাংক শাখা হওয়া খুবই প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগ নেব।

নোভা

×