ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

নবাবগঞ্জে কৃষি জমির মাটি লুট, রাতভর চলছে অবৈধ বেচাকেনা

বিপ্লব ঘোষ, দোহার, নবাবগঞ্জ, ঢাকা

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১৪ মে ২০২৫

নবাবগঞ্জে কৃষি জমির মাটি লুট, রাতভর চলছে অবৈধ বেচাকেনা

ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ

“দিনে পুকুরের চালা বান্ধি, রাতে ইটের ভাটায় মাটি বিক্রি করি” গত সোমবার রাতে সরেজমিনে গেলে এভাবে দাম্ভিকতার সাথে সাংবাদিকদের জানান স্থানীয় মাটিখেকো মো: স্বপন মিয়া। তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারীপাড়া ইউনিয়নের বিষমপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানের মাটি ভরাটের কাজ করছেন। মাটি কাটছেন পাশের কৃষি জমিতে। 

দিনে এলাকাবাসী দেখেন কবরস্থানের মাটি ভরাট করতে ও পুকুরের চালা বাঁধতে। কিন্তু রাত হলেই তৎপর হয়ে উঠছে মাটি খেকোরা। ইটভাটার পাশাপাশি মাটি বিক্রি করছেন বসত বাড়িতেও।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মাটি খেকো স্বপন আওয়ামী লীগের আমলেও ছিলেন মাটিকাটার সর্দার, এখনো তিনি সর্দার। 

জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষি জমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমি থেকে মাটি সংগ্রহ বা ভারী যানবাহনে পরিবহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীদের জন্য জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অসাধু চক্র এসব আইন তোয়াক্কা না করেই কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বড় বড় ট্রাক ও মাহেন্দ্রা দিয়ে মাটি বিক্রি করছেন। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার শিকারীপাড়া ইউনিয়নের বিষমপুরে কবরস্থান পার্শ্ববর্তী নীচু জমিতে রাতের আধাঁরে দুটি ভেকু মেশিন (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে দেদাচ্ছে মাটি কাটা হচ্ছে। আর লাইন ধরে মাহেন্দ্র এসে ভরাট করে মাটিগুলো নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় এওবি ইটাভাটায় এবং বসতবাড়িতে। সেখানে কথা হয় স্লিপ কাটায় ব্যস্ত রানা নামে এক যুবকের সাথে। তিনি বলেন, স্বপন মিয়া তাকে বেতন দিয়ে শুধু হিসাব রাখার জন্য তাকে রেখেছে। তবে অনুমতি আছে কি না তিনি জানেন না। এছাড়া মাটি পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে নসিমন ও মাহেন্দ্রা। আর যারা এসব নসিমন ও মাহেন্দ্রা চালাচ্ছেন তাদের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। এতে প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারীরা। এদিকে মাটি কেটে নসিমন ও মাহেন্দ্রা দিয়ে পরিবহণের চলাচলের সড়কগুলো এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। মাটিবাহী ট্রলি, ট্রাক্টরের দাপটে ভাঙছে রাস্তাঘাট। ধুলো-বালিতে হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য।

স্থানীয় চায়ের দোকানে কথা হয় কয়েকজনের সাথে, তারা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমাদের গ্রামের কেউই রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকট শব্দের নসিমন গাড়ি ও মাহেন্দ্রা গাড়ি চলাচল, শেষ হয় ভোরে। 

কালাম নামে এক ব্যক্তি জানান, মূলত তাকে (স্বপনকে) কবরস্থান ভরাটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বপন ২ ট্রাক মাটি কবরস্থানে ফেললে ২০ ট্রাক ফেলে পার্শ্ববর্তী ইটভাটায় আর বসতবাড়িতে বিক্রি করেন দেন। এটা আসলে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার একটা কৌশল। স্বপন চিহ্নিত মাটি খেকো। আওয়ামী লীগের আমলেও সবাইকে ম্যানেজ করে মাটি কেটেছে এখন আবার অন্য দলের লোকজনকে ম্যানেজ করে মাটি কাটায় নেমে পড়েছে।

কাশেম আলী নামে আরেকজন জানান, ‘কবরস্থানকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে এমন অপকর্ম মেনে নেওয়া যায় না। যদি শুধুই কবরস্থান মাটি ফেলত এতদিন শেষ হয়ে যেত রাস্তাও নষ্ট হতো না। আসলে প্রশাসন যেন ওকে বাঁধা না দেয় তাই কৌশল অবলম্বন করেছে। ওকে বিচারের আওতায় আনা উচিত।’

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দফতর সূত্রে জানা যায়, নবাবগঞ্জে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১৭,৫১১ হেক্টর। যার মধ্যে এক ফসলি জমি ৬৯৯৩ হেক্টর, দুই ফসলি জমি ৮৬২৮ হেক্টর, তিন ফসলি জমি ২১৮১ হেক্টর। এছাড়া তিনের অধিক ফসলি জমির পরিমাণ ২৫ হেক্টর ও আবাদযোগ্য পতিত জমি ২৪৫ হেক্টর। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ বিঘা কৃষিজমি কথিত মাটি ব্যবসায়ীরা বিনষ্ট করছে। পুকুর খনন ও মাছ চাষের কথা বলে মাটি তুলছে তারা উদ্দেশ্য মাটি বিক্রি করে অধিক মুনাফা।

নবাবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসমা জাহান বলেন, ‘এভাবে কৃষি জমির মাটি বিক্রি করলে ধীরে ধীরে কৃষি জমির সংখ্যা কমে যাবে। মাটি কাটার সময় উপরের ৮ইঞ্চি পর্যন্ত যে টপ সয়েল অংশ রয়েছে কেটে নেওয়ায় মাটির উর্বরতাও কমে যায়। এখন কৃষি জমির মাটি কাটার বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এব্যাপারে অভিযুক্ত মাটি ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া বলেন, আমি পুকুর খনন করছি তাই অনুমতি প্রয়োজন হয়নি। এর বেশি তিনি কথা বলতে রাজি হয়নি। 

এবিষয়ে নবাবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসিফ রহমান বলেন, ‘বিষয়টি তার জানা নেই তবে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

মিরাজ খান

×