
ছবি: সংগৃহীত
লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী চরাঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তামাক চাষ। গত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে দ্বিগুণ জমিতে এই বিষাক্ত ফসল চাষ হয়েছে। অধিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন। কিন্তু এই লাভের পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিশেষ করে চরাঞ্চলের শিশুদের জন্য।
জেলার আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম ও সদর উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী চরগুলোতে এবার তামাক চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে। অথচ গতবছর এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ হাজার ৩০০ হেক্টর। কৃষকরা বলছেন, কম খরচে বেশি লাভ এবং কোম্পানির নানা ধরনের সুবিধা পেয়ে তারা ধান, ভুট্টা, আলুর মতো প্রচলিত ফসল বাদ দিয়ে তামাকে ঝুঁকছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তামাক চাষের পরিচর্যা, পাতা ছেঁড়া, শুকানো, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে। তামাক পাতার গন্ধ, প্রাকৃতিক নির্যাস এবং রাসায়নিক স্প্রে শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা এসব বিষাক্ত পরিবেশে কাজ করে তারা।
আদিতমারী উপজেলার কৃষক হারুন মিয়া বলেন, “২৫ শতাংশ জমি চার হাজার টাকায় লিজ নিয়ে তামাক চাষ করছি। কোম্পানি সার, বীজ, কীটনাশক সব দিয়ে দিয়েছে। পাতা শুকিয়ে সরাসরি বিক্রি করা যায়, দামও ভালো। নিজের সন্তানরাও কাজে হাত লাগাচ্ছে।”
সদর উপজেলার হরিণচওড়ার কৃষক জাহিদুল ইসলাম জানান, “ভুট্টা আর বাদামের পাশাপাশি তামাক করেছি। জমিগুলো বছরে একবারই চাষের উপযোগী হয়, তাই লাভের আশায় সময়টা কাজে লাগাতে হয়। শ্রমিক রাখতেও খরচ, তাই বাড়ির মেয়েরাও ও বাচ্চারাও কাজ করে।”
চিকিৎসকরা বলছেন, তামাক চাষের সঙ্গে জড়িত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ রকমের। লালমনিরহাট জেলা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. তপন কুমার বলেন, “তামাক গাছ ও পাতার গন্ধ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক শিশুদের ফুসফুস, ত্বক ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। শিশুদের এই চাষে জড়ানো আইনগতভাবেও অপরাধ এবং নৈতিকভাবেও ভয়াবহ।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর লালমনিরহাট জেলা সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান লাডলা বলেন, “বিভিন্ন তামাক কোম্পানির লোভনীয় অফার এবং লাভের আশায় কৃষকরা এখন অধিক হারে তামাক চাষ করছেন। কিন্তু এই চাষের সঙ্গে পরিবারের শিশুরাও জড়িয়ে যাচ্ছে—যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত। সরকারের উচিত বিকল্প ফসল চাষে প্রণোদনা বাড়ানো এবং শিশুদের বিষয়ে কড়া নজরদারি নিশ্চিত করা।”
তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করছেন। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, “তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবান্ধব ও লাভজনক বিকল্প ফসল যেমন ভুট্টা, সূর্যমুখী, মসুর, শাকসবজি—এসব চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।”
তিস্তার চরাঞ্চলের অনেক জমি ধান, ভুট্টা, আলু কিংবা শীতকালীন সবজির জন্য উপযুক্ত হলেও বর্তমানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমিতে তামাকের দখল। কৃষকের লাভের হিসাবের আড়ালে শিশুর ভবিষ্যৎ এবং জনস্বাস্থ্যের এই ক্ষয় রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
আসিফ