
কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের টিআরএমভুক্ত পাখিমারা বিলের বর্তমান দৃশ্য। ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় জমির মালিকরা এখন ইচ্ছানুযায়ী মাছ ও ধান চাষ করছে।
কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পে তিন জেলার নদীপাড়ের ৪৪ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলেও এই প্রকল্প ভুক্ত টিআরএম ( টাইডাল রিভার ম্যনেজমেন্ট) প্রকল্পের আওতাভুক্ত জমির মালিকদের ২২শ’ পরিবারে চলছে বোবা কান্না। টিআরএম প্রকল্পে হুকুম দখল করা ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা ৮ বছরেও ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি।
জমির মালিকদের ৪ বছরের ক্ষতিপূরণ পাওনা হলেও তাদের মাত্র ২ বছরের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে এই টিআরএম প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ার পর নতুন করে এই প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পভুক্ত জমির মালিকরা ক্রম বাঁধ দিয়ে জমিতে ধান ও মাছ চাষ করছে। কপোতাক্ষ খননে এলাকায় নদে কিছুটা নব্য ফিরে পেলেও টিআরএম প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় নতুন করে এই নদ ভরাট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভেস্তে যেতে বসেছে ২৬২ কোটি টাকার কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্দতা দূরীকরণ প্রকল্প। টিআরএম প্রকল্পের এই জমির বেশিরভাগ চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়ে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
এ অঞ্চলের কপোতাক্ষ অববাহিকার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে সাবেক সরকারের ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ১ম পর্যায়’ প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকারমূলক একটি প্রকল্প ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় সরকারের পক্ষ থেকে জমির মালিকদের সকল ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ বছর অধিগ্রহণকৃত পাখিমারা বিলের ১৫৬২ একর জমিতে জোয়ারাধার (টিআরএম) কার্যক্রম চললেও জমির ফসলের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের অর্থ সম্পূর্ণ দেওয়া হয়নি।
তথ্যানুযায়ী, ১ম পর্যায় প্রকল্পে ৬ বছর টিআরএম চলাকালীন পাখিমারা বিলের জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০১৫ সাল থেকে ২০ সাল পর্যন্ত পাওয়ার কথা ছিল ৪০ কোটি ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১২ টাকা। জমির মালিকদের দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি ১২ লাখ ৭২ হাজার ৭৬৪ টাকা। প্রথম ২ বছরের বকেয়া টাকাসহ পরবর্তী ৪ বছরের মোট ২৯ কোটি ৮৮ লাখ ৪ হাজার ১৪৮ টাকা জমির মালিকরা এখনও পায়নি।
জমির মালিকদের অভিযোগ ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলনের জন্য সরকারের শর্তানুযায়ী এস,এ খতিয়ানের পর্চা, নামপত্তন, ক্রয়ের দলিল, পিঠ দলিল, হাল জরিপের পর্চা, খাজনা প্রদানের হাল দাখিলা, প্রাপ্য জমির হিসাব বিবরণী, নাগরিক সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি (চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত) সহ ১২ রকমের কাগজ জেলা প্রশাসকের এল এ শাখায় জমা দিতে হয়।
এসকল শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে যাদের প্রথম বছরের টাকা ছাড় করা হয়েছে তাদের অনেকেই ২য় বছর টাকা উত্তোলন করতে পারেনি বলে ইতোপূর্বে সচিব বরাবর অভিযেগ করেন। এলাকার অধিকাংশ কৃষকদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী ৪ বছর (২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১) তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি এবং তাদের জমিতে ফসলও ফলাতে পারেনি।
পাশাপাশি এই প্রকল্পের জন্য ২০১৫ সালে সংযোগ খাল নির্মাণের জন্য ১০.২৮ একর জমি স্থায়ী অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির মালিকরা এখনো কোনো ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি। সংযোগ খালের জন্য ৩৪টি পরিবার বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। পেরিফেরিয়াল বাঁধ মেরামত করে টিআরএম চালু করাও হচ্ছে না। এতে একদিকে জমির মালিকরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি নদী ফের নব্যতা হারাচ্ছে।
এদিকে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প-২য় পর্যায়’ (জুলাই ২০২০ হতে জুন ২০২৪) ৫শ’ ৩১ কোাটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দের ৪ বছর মেয়াদের কার্যক্রম শুরু হলেও জমির মালিকরা এই ক্ষতিপূরণের টাকা এখনো পায়নি। এ প্রকল্পে ১ম দুই বছরের জন্য একর প্রতি প্রতিবছর ৫৩,৭১৩ টাকা হিসেবে মোট ১৬ কোটি ৭৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য বরাদ্দ রাখা হলেও সে অর্থ জমির মালিকদের দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযাগ।
টিআরএম প্রকল্প ভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের অভিযোগ, টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে জলাবদ্ধতা থেকে কপোতাক্ষ অববাহিকার প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ উপকৃত হলেও তারা সমস্যায় রয়েছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জেলা প্রশাসন কে দেওয়া হয়। টাকা বিতরণ করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের।
অপরদিকে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব শেখ মইনুল ইসলাম মঙ্গলবার এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিতীয় ফেজের কাজের জন্য জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবাদ ১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দেয়া হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড মাত্র ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এ বরাদ্দের কারণে এই টাকা নেওয়া হয়নি। এ কারণেই জমির মালিকরা দুই বছরের ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি বলে তিনি জানান।