
সৈয়দপুরে বালতি ও ট্রাঙ্ক তৈরিতে কাজ করছে শিশু
উত্তরাঞ্চলের বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হতে এখনো ১৫ দিন বাকি। তবে দক্ষিণাঞ্চল পূর্বাঞ্চলে শুরু হয়েছে ধানকাটা। তাই উত্তরাঞ্চলের কায়িক শ্রমিকরা ছুটছেন সেদিকে কাজের সন্ধানে। বুধবার নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে দেখা যায় দল বেঁধে ওরা ট্রেনে যাচ্ছে ধান কাটতে। হাতে ভারের লাঠি, কাস্তে এ আছে রাতে ঘুমানোর চাদর ও নিজেদের ব্যবহারের কাপড়চোপড়।
মে দিবস সম্পর্কে কিছু কথা বলার পর তারা বলছিলেন মে দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। তবুও আমাদের মতো মানুষকে পেটের দায়ে বেরিয়ে পড়তে হয় কাজে। কারণ, এক বেলা কাজ না করলে পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। ফলে, মে দিবস পালন করা এসব মানুষের কাছে একপ্রকার বিলাসিতাই।
মেট্রিক পাস কায়িক শ্রমিক ডিমলার চরখড়িবাড়ির রমিজ খান (২৬) বললেন, আমি মে দিবস নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাটি পড়েছিলাম। কবিতার দশম লাইনটি আমার বেশি মনে পড়ে। সেখানে কবি লিখেছেন, মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের ¯পর্শে/কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুধা আর গলার শিকলকে? তাই বলছিলাম কবিতার লাইনের মতোই আহ্লাদি হাতের স্পর্শে পেটের খিদে মরে না আমাদের। ঘরে স্ত্রী সন্তান আছে।
তাদের মুখে হাসি ফুটাতে প্রতিদিন শ্রম দিতে হয় আমাকে। মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস জানি। এর আগে দিবসটি পালন করতে গিয়ে উল্টো পকেটের টাকা খরচ হয়। শ্রমিক নেতারা চাঁদা তুলেন। সে টাকায় পোলাও রান্না হয়। রং খেলা হয়। রাতে গানের শিল্পী ভাড়া করে এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হয়। রমিজের প্রশ্ন এটাই, কি মে দিবস বা শ্রমিক দিবস। তাই সব বাদ দিয়েছি। নিজের সংসার নিজের পেটের ভাত আমাকেই জোগার করতে হবে।
কায়িক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল বোরো মৌসুমে প্রতিবারের মতো এবারেও বোরো চাষিরা কৃষি শ্রমিকের সংকটে রয়েছেন। বিশেষ করে জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, সান্তাহার, আদমদীঘি, আত্রাই, নওগাঁ, নাটোর, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এ সংকট। তাই উত্তরের হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক কাজের সন্ধানে ট্রেনে, বাসে ও খোলা পিকআপে চড়ে ওই সব এলাকায় ছুটছেন।
প্রতিদিন সকালে নীলফামারীসহ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর, রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার দিনমজুররা ভিড় করছেন উত্তরের রেলস্টেশনগুলোতে। বিশেষ করে চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী ও সৈয়দপুরে রেলস্টেশনে কৃষিশ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা ইউনিয়নের বটতলী এলাকার কৃষিশ্রমিকের সর্দার আশরাফুল হক।
তিনি জানান, গ্রামের ১০ জনের একটি দল নিয়ে ধান কাটতে যাচ্ছেন সান্তাহারে। ওই এলাকায় প্রতিবছর ধান কাটতে যান তারা। ওখানকার গৃহস্থদের সঙ্গে এই কৃষিশ্রমিক সর্দারের যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মাঠে ধান পাকলে মোবাইল ফোনে আমাদের ডেকে নেয় সান্তাহারের গৃহস্থরা। তিনিও বললেন, আগে মে দিবস পালন করতে হতো পকেটের টাকায়। সব বাদ দিয়ে দিবসটা আর পালন করি না।
শ্রমিক যখন শিশু ॥ সৈয়দপুর শহরের মিস্ত্রি পাড়ার একটি বালতি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আসিফ। তার বাড়ি সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নে। পিতা ইটভাঁটিতে কাজ করেন। আসিফকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবার এবং সপ্তাহে মজুরি দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। এই বালতি ফ্যাক্টরির পাশের একটি বাক্স তৈরি কারখানায় কাজ করে গুড্ডু।
সারাদিন কাজ করে তিনবেলা খাওয়ার পর তাকে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। সৈয়দপুর শহরের রেলওয়ে বাজারের বিভিন্ন হোটেলে কাজ করে মজিদ, হাবিব, জয়নাল, কাশেম ও মিঠু। এদের গড় বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। এরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। এদের মধ্যে কারও বাবা, আবার কারও মা নেই। ফলে, বাঁচার অবলম্বন হিসেবে এই শিশুরাই হাল ধরেছে সংসারের। এই শহরের নিয়াতমপুরে হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করে আরমান। ভোর থেকে রাত অবধি সে লোহালক্করের কাজ করে। অথচ কাজ শেষে তার মজুরি মেলে মাত্র ২০০ টাকা।
কষ্ট হলেও সহ্য করেই তাকে কাজ করতে হয়। এদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরা মে দিবস কি জানে না, বোঝে না বা শিশুশ্রম কি এ বিষয়ে কিছুই শোনেনি। তবে তারা বলেছে, পহেলা মে কাজের ছুটি। এদিন রং খেলা হবে, গান বাজনা হবে, আর ভালো খাওয়া পাওয়া যাবে। শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যের শহর নীলফামারীর সৈয়দপুরে দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সঠিক মজুরি অধিকার বঞ্চিত এ শহরে এখন প্রায় ১০ হাজার শিশু পানির দামে শ্রম বিক্রি করে।
শিশুশ্রম যদিও অবৈধ, তারপরও হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা এসব শিশু পরিবারের অভাব মেটাতে পানির দরে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি জরিপে জানা যায়, সৈয়দপুরে বিভিন্ন মিল, শিল্প, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে জড়িত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে অভাব-অনটনে এর সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৈয়দপুরে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও হালকা শিল্প মিলে ৫ হাজার মিল ফ্যাক্টরি ও কারখানা রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে মিনি গার্মেন্টস, গুল ও আগরবাতি ফ্যাক্টরি, বাক্স-বালতি কারখানা, মোমবাতি ফ্যাক্টরি, লেদার ফ্যাক্টরি, কাঠের ফার্নিচার দোকান, চাতাল, ওয়েলডিং, হোটেল রেস্তোরাঁ, মোটরসাইকেল গ্যারেজ, নির্মাণ শ্রমিক, বেকারি শিল্পসহ অসংখ্য মিল, ফ্যাক্টরি, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান।