
রাজধানীর কদমতলী থেকে শনিবার জাল টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ একজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ
কোরবানির ঈদ ঘিরে অন্য বছরের মতো এবারও সক্রিয় জাল টাকার কারবারিরা। সুযোগ কাজে লাগাতে রাজধানীর কদমতলীতে তৈরি করা হচ্ছিল জাল টাকা। সুনির্দিষ্ট তথ্য ও গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে যাত্রাবাড়ী থানাধীন কদমতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেশী-বিদেশী জাল নোট তৈরি চক্রের প্রধান জাকিরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ।
ডিবি লালবাগ বিভাগের একটি দল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটি বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তাররা হলো চক্রের প্রধান লিয়াকত হোসেন জাকির ওরফে মাজার জাকির ওরফে গুরু জাকির (৪০), তার দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ বেগম (২৫), লিমা আক্তার রিনা (৪০) ও সাজেদা আক্তার (২৮)।
ডিবি পুলিশ বলছে, ঈদুল আজহা টার্গেট করে চক্রটি বিপুল পরিমাণ জালনোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঢাকায় তৈরি এই জাল নোট বিক্রির জন্য যোগাযোগ হতো অনলাইনে আর লেনদেন হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। লেনদেনের পর কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হয় জাল নোট। যার বেশিরভাগ এবার যাচ্ছে মফস্বলে। টার্গেট কোরবানির পশুর হাট।
অভিযান সম্পর্কে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, অভিযানে দুটি বাসা থেকে প্রায় সোয়া কোটি টাকা এবং আরও প্রায় তিন কোটি জাল টাকা তৈরির মতো বিশেষ কাপড়/কাগজ, বিশেষ ধরনের কালি, ল্যাপটপ, চারটি প্রিন্টার, বিভিন্ন সাইজের কয়েক ডজন স্ক্রিন/ডাইস, সাদা কাগজ, হিটার মেশিন, নিরাপত্তা সুতাসহ জাল টাকার হরেক রকম মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ২০০, ৫০০, এক হাজার টাকার জাল নোট ও ভারতীয় ৫০০ রুপির বিপুল পরিমাণ জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে জাল টাকার খুচরা ও পাইকারি কারবার করার পাশাপাশি বিভিন্ন মানের জাল টাকা ও জাল রুপি তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ লিয়াকত হোসেন জাকির। তিনি ২০১২ সাল থেকে ৫০০ ও এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করলেও বর্তমানে সাধারণ মানুষ যেন সন্দেহ করতে না পারেন, সেজন্য বড় নোটের পাশাপাশি ১০০ ও ২০০ টাকার জাল নোট তৈরি করত।
বর্তমানে কাগজ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের কালি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় জাকির এক হাজার টাকার ১০০টি নোটের বান্ডেল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করত। গত ১২ বছরে জাকির কখনো জাল টাকা খুচরায় বিক্রি করেনি। নারী-পুরুষ মিলে তার প্রায় ১৫/২০ জন কর্মচারী আছে, যাদের মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতন দিতেন।
তারা ব্যক্তি পর্যায়ে জাল টাকা বিক্রি করলে ধরা পড়তে পারে, সেই ঝুঁকি এড়াতে অনলাইনে (বিশেষত ফেসবুক ও মেসেঞ্জার) দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কুরিয়ারের মাধ্যমে জাল নোট বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিত তারা।
তিনি বলেন, জাল নোট তৈরির সময় জাকিরের সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলে জাকির মাজারে মাজারে অবস্থান করত। মাজারের কচ্ছপ, মাছের খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে তাকে ‘মাজার জাকির’ বলা হয়।
অপরদিকে বিভিন্ন জেলায় জাল নোটের ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানা স্থাপনকারীরা জাকিরের কাছ থেকে কারিগর, সফট কপি, পরামর্শ এমনকি মডেল জাল রুপি নিয়ে থাকে বলে জাকিরকে গুরু জাকির বলেও চেনে অনেকে।
অভিযান সম্পর্কে মশিউর রহমান বলেন, গত রোজার ঈদের আগে জাকিরের জাল নোটের দুই পাইকারি ক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই নারী মাদকের একটি মামলায় কারাগারে গিয়ে জালনোট চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপর জামিনে এসে জাল টাকার কারবার শুরু করে। ঈদ সামনে রেখে সে বিপুল পরিমাণ জাল নোট কেনার জন্য এসেছিল। তার সূত্র ধরে জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিয়ে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সারা বছর গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে হয়। নানান ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। কারণ চক্রগুলো সারা বছরই জাল নোট তৈরি করছে।
কয়েকদিন আগে এক নারীই ৫০ লাখ জাল টাকা নিয়েছে জাকিরের কাছ থেকে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, তারা কী পরিমাণ জাল নোট বাজারে ছাড়ছে। চক্রে ১৫-২০ জন এজেন্ট রয়েছে, যারা সারাদেশে জাল টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঈদুল আজহা সামনে রেখে গরু-ছাগল বিক্রি বা লেনদেনের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে টাকা যাচাই-বাছাই করে নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
চক্রের হোতা ও জাল নোট তৈরির কারিগর জাকিরের বিষয়ে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, জাকির অত্যন্ত দক্ষ জাল নোট তৈরির কারিগর। তার চক্রে বহু নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এসব কর্মচারীকে মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেতন দিত সে।
জাকির যে বাসায় অবস্থান করে জাল নোট বানাত, সেই বাসার আশপাশে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি করত যেন তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরতে না পারে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলেই পালিয়ে যেত।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, চক্রটির বিভিন্ন জেলায় তাদের এজেন্ট আছে। তারা অনলাইনে যোগাযোগ করে অর্ডার কনফার্ম করে। এজন্য বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পেমেন্ট পাওয়ার পর তারা কুরিয়ারে করে জেলা শহরে পাঠাচ্ছে জাল টাকা। জেলা শহরে বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাট আছে। সেখানে তারা এই জাল টাকাগুলো নিজেরা কেনাকাটা করে পাশাপাশি জাল টাকা বিক্রি করে।
হারুন বলেন, ঈদ কেন্দ্র করে মফস্বল পর্যন্ত জাল টাকার চালান ছড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরুর ব্যবসায়ীরা। কারণ গরু ব্যবসায়ীরা যা দাম বলে, সেই দামেই গরু কিনে নেয় জাল টাকা দিয়ে। সেখানে জাল টাকা চেক করার মেশিনও অধিকাংশ গ্রামীণ কোরবানির হাটে নেই। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খুদে ব্যবসায়ীরা।
আমাদের প্রত্যেকটি মার্কেট ও গরুর হাটে টাকা চেনার মেশিন থাকা জরুরি উল্লেখ করে হারুন বলেন, এই জাল টাকা কারবারি চক্র বাজারে কত কোটি টাকা ছেড়েছে তা এখনো জানি না। তাই প্রত্যেকটি কোরবানির হাটে জাল টাকা ধরার মেশিন স্থাপন করা উচিত। কোরবানির হাটে ও মার্কেটগুলোতে ঈদের সময় প্রচুর ভিড় থাকে। সেই সুযোগে তারা কিন্তু সহজে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
এই জাল টাকার কারবারের শেষ কোথায়? যারাই কারবার করছেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন আবার জামিনে বেরিয়ে একই কারবারে জড়িয়ে পড়ছেনÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু জাল টাকা না, ডাকাতি ছিনতাইসহ নানা আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জেলহাজত থেকে তারা কীভাবে জামিনে বেরিয়ে যায় তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। নতুন করে জাল টাকার কারবারে জড়িয়ে যাওয়া কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, জেলে থাকা অবস্থায় জাল টাকার কারবারির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের এজেন্ট বানানো হয়। লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতে পারলে ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। লোভে পড়ে চক্রের মাধ্যমে জড়িয়েছে জাল টাকার কারবারে।