ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ডিশ ব্যবসার আড়ালে চার বছরেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করে আলিশান বাড়ি

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর 

প্রকাশিত: ১৭:৪৩, ১০ মে ২০২৪; আপডেট: ১৯:০৮, ১০ মে ২০২৪

ডিশ ব্যবসার আড়ালে চার বছরেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করে আলিশান বাড়ি

অসীম গাইন ও তার স্ত্রী। ফাইল ফটো

এক সময় করতেন ডিশ ব্যবসা। বাড়িতে ছিল একটি টিনশেট ঘর। কিন্তু বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তর বিক্রি করে মাত্র ৪ বছরেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। ব্যাংকে রয়েছে কোটি কোটি টাকা। নির্মাণ করছেন আলিশান বাড়িও। 

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার প্রধান অভিযুক্ত অসীম গাইনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি। 

পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার করা হলেও জড়িত সবাইকে আনা হবে আইনের আওতায়। এদিকে অসীমের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অসীম গাইন (৪৫) ডিশ ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে দেশজুড়ে তৈরি করেছেন চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এখন লাপাত্তা তিনি। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের কলাবাড়ি এলাকার ফটিক চন্দ্র গাইনের ছেলে অসীম গাইনের ৪ বছর আগেও ছিল একটি টিনশেট ঘর। নতুন জায়গায় রাজৈর-কদমবাড়ি সড়কের পাশে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন আলিশান বাড়ি। 
চারপাশ দেয়াল আর নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘেরা। তবুও সেখানে নেই অসীম কিংবা তার স্ত্রী রিক্তা গাইনের উপস্থিতি। বাড়িতে গিয়ে কথা হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে। আলিশান বাড়ি।স্বজনরা জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মামলা হলে এলাকা ছাড়া তিনি। অসীম ষড়যন্ত্রের শিকার দাবি করে স্বজনরা জানান, ডিশের ব্যবসার টাকায় বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৯ মার্চ মাদারীপুরের ১৮টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। অর্থের বিনিময়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র সরবরাহ করে একটি চক্র। এ সময় আটক করা হয় ৮ জনকে। উদ্ধার করা হয় ইলেকট্রিক ডিভাইস ও একাধিক মোবাইল ফোন। এই ঘটনায় সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারি রেজাউল করিম বাদী হয়ে প্রধান অভিযুক্ত অসীমসহ ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১৫ জনের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায়  মামলা করেন। পরে অভিযান চালিয়ে অসীমের সহযোগি রনি বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনও পলাতক প্রধান অভিযুক্ত। 

পুলিশ জানায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা আর অবৈধ অর্থ অর্জনে আলিশান বাড়ি নির্মাণের লিখিত অভিযোগ পেয়ে অসীম গাইনের সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগই নয়, বেশকিছু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত অসীম ও তার সহযোগিরা। এক সেট প্রশ্ন উত্তরসহ দেয়ার শর্তে এক একজনের কাছ থেকে ৫-১২ লাখ টাকা নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। অসীমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করছে জেলার গোয়েন্দা পুলিশ।

প্রধান অভিযুক্ত অসীম গাইনের বৌদি গৌরি দে বলেন, পারিবারিকভাবে কয়েক বিঘা জমিজমা রয়েছে অসীমের। দীর্ঘদিন ধরে সে ডিশলাইন ও ইন্টারনেট ব্যবসা করে। এছাড়া গরু ক্রয়-বিক্রয় করে। এই ব্যবসার আয়ের অর্থ দিয়েই অসীম বাড়ি নির্মাণ করেছে। কিন্তু একটি চক্র অসীমের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। অসীম নির্দোষ। সেটা একদিন আদালতেই প্রমাণ মিলবে।

অসীমের ভাইয়ের স্ত্রী বিউটি গাইন বলেন, মানুষে কিসের জন্য এমন দুর্নীতি উঠাইছে তা বলতে পারবো না। অসীম পুরোপুরি নির্দোষ। সে এলাকায় অনেক মানুষের সাহায্য সহযোগিতা করে। তার নামে বাজে কোন বদনাম নেই। কিন্তু একটি চক্র, অসীমকে ফাঁসাতে চাচ্ছে, আমরা সবাই সঠিক তদন্ত চাই।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর মাদারীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, অসীম গাইনের বিরুদ্ধে মাদারীপুর ও রাজধীন ঢাকায় একাধিক মামলা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিউজও হয়েছে। সেই নিউজের কপিও সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া মাদারীপুর দুদক কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগও পাওয়া গেছে। অসীমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের কারণ অনুসন্ধান করছে দুদক। প্রধান কার্যালয় থেকে নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানিয়েছেন, অসীম গাইন ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও এই প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র সরবরাহের কাজে জড়িত। অসীম রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের সাথে লাখ লাখ চুক্তি করেন। পরে তার অন্যান্য সহযোগিদের নিয়ে উত্তরপত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরবারহ করেন। পুরো ঘটনা জেলার গোয়েন্দা পুলিশ নজরদারি রেখেছে এবং তদন্তও করছে। এছাড়া এটা নিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে আলাদাভাবে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও কাজ করছে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে পুলিশ ও দুদককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ ছাড় পাবে না।
 

 এসআর

×