ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

লালকুঠিরের ঐতিহ্য ফিরাতে সরাতে হবে সদরঘাটের টার্মিনাল

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪; আপডেট: ২১:০৪, ৩০ মার্চ ২০২৪

লালকুঠিরের ঐতিহ্য ফিরাতে সরাতে হবে সদরঘাটের টার্মিনাল

পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক লালকুঠির সংস্কার কাজ চলছে

  • ভাংতে হবে বিআইডব্লিউটিএ’র লঞ্চ টার্মিনালসহ একাধিক স্থাপনা

পুরান ঢাকার লালকুঠি ভবনের পুরনো আদল ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পাশে অবস্থিত ঐতিহাসিক নর্থব্রুক হল বা লালকুঠির সামনের লঞ্চঘাটসহ সব স্থাপনা সরাতে নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু লালকুঠির সামনে গড়ে তোলা স্থাপনা সরানো নিয়ে দুই সংস্থার সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।  

আহসান মঞ্জিলের মতো লালকুঠির সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে চায় সরকার। এ জন্য লালকুঠি সংস্কারসহ সামনের সব স্থাপনা সরাতে চায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে লালকুঠির পুরনো আদল ফেরাতে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এই সংস্কারের কাজ শেষ করতে চায় ডিএসসিসি। এ জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হচ্ছে এটি। 
তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে ভবনটির সামনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা সরকারি দুই সংস্থার স্থাপনা সরানো নিয়ে। এ জন্য ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। এই কমিটিতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিইটিএ)’র দুইজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কমিটিতে কোনো প্রতিনিধি না দিয়ে উল্টো আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের জন্য নৌ-মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

এ ছাড়া লালকুঠির ভবনের সামনে ঢাকা ওয়াসার একটি পানির পাম্প রয়েছে। পাম্পটি স্থানান্তরের জন্য ওয়াসাকে চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। তবে বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা না করে দিলে পাম্প স্থানান্তর করবে না বলে জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ফলে বিভিন্ন সংস্থার স্থাপনা না সরানোর কারণে লালকুঠির সংস্কারের কাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার লালকুঠির এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের জানান, এই স্থাপনার (লালকুঠি) দুই সীমানার কোণ থেকে ৪৫ ডিগ্রিতে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেটা হলে নদী থেকে সুন্দরভাবে স্থাপনাটা দেখা যাবে। রাতে আলোকমালায় সজ্জিত থাকবে। সবাই ঢাকাকে উপভোগ করবে। নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা সব অবকাঠামো, পন্টুন ও লঞ্চঘাট সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। এমনকি সামনের রাস্তাটা দখল করে বানানো পার্কিংয়ের জায়গাটাও খালি করে দিতে হবে।
ডিএসসিসির মেয়র বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পুরোনো আদল ফিরিয়ে আনতে এটি সংস্কার করা হচ্ছে। লালকুঠি আমাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। যেটা লর্ড ব্রুকের সময় ১৮৭৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি মূলত টাউন হল ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ঢাকায় এলে এখানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সুতরাং আমরা সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে লালকুঠিকে পূর্ণভাবেই সংস্কার করছি।’
পরে গত ১ ফেব্রুয়ারি লালকুঠির নান্দনিক সৌন্দর্য বুড়িগঙ্গা থেকে দেখার সুযোগ করে দিতে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবীকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, ডিএসসিসির কর অঞ্চল-৪’র আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, উপসচিব পদমর্যাদার নৌ-মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, পরিচালক পদমর্যাদাসম্পন্ন বিআইডব্লিউটিএর একজন প্রতিনিধি ও ডিএসসিসির অঞ্চল-৪’র নির্বাহী প্রকৌশলী।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘লালকুঠির নান্দনিক সৌন্দর্য বুড়িগঙ্গা নদী থেকে দৃশ্যমান করার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কাজ হলো লালকুঠির দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত ৪৫ ডিগ্রি কৌনিক অংশে বিদ্যমান লঞ্চঘাটসহ সকল স্থাপনা সরেজমিনে পরিদর্শন করে অপসারণের জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করা। আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে বিআইডব্লিউটিএর কোনো প্রতিনিধি এখনো পাওয়া যায়নি। কমিটির অন্য সদস্যদের নিয়ে কার্যক্রম চলছে। দুই-একদিনের মধ্যে সরেজমিনে লালকুঠি এলাকা পরিদর্শন করবে কমিটি।’
লঞ্চ টার্মিনালসহ একাধিক স্থাপনা ভাঙতে হবে ॥ ডিএসসিসির মেয়রের নির্দেশমতে লালকুঠির দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদী তীরে বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদী বন্দরের লঞ্চ টার্মিনালের এক অংশসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙতে হবে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ৪০০ ফুট ওয়াকওয়ে, ৪টি টিকেট কাউন্টার, যাত্রী বিশ্রামাগার ১টি (ভিআইপি কক্ষ), লঞ্চের টিকেট বুকিং কাউন্টার ১-৩ কক্ষ,  ৪টি গ্যাংওয়ে, ৩৫০ ফুট বাউন্ডারি ওয়াল, ১০০ ফুট করে ৪টি পন্টুন ও বিআইডব্লিউটিএর স্টাফদের ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এ সব স্থাপনা ভাঙা ও সরানো হলে নৌ-যট সৃষ্টিসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার যাত্রী সাধারণের যাতায়াতে ব্যাপক সমস্যা হবে বলে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান।
বিআইডব্লিউটিএর সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হলের (লালকুঠি) দক্ষিণ পার্শ্বে লালকুঠি লঞ্চঘাট। এখানে বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর উঁচু এবং বড় কোনো স্থাপনা নেই। তবে যাত্রী সাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে সদরঘাট মূল টার্মিনাল ভবনের সামনে নদীতে স্থাপিত পন্টুনে, লঞ্চ বার্দিংয়ের সমস্যা ও লঞ্চে যাতায়াতকারী যাত্রী সাধারণের গাড়ি পার্কিং এবং নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে তীরভূমিতে ৪টি গ্যাংওয়ে ও জেটি এবং ৪টি যাত্রী প্রবেশ টিকিট কাউন্টার নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ছোট আকারের ২টি ভিআইপি যাত্রী বিশ্রামাগার ও ২টি টিকেট কাউন্টার রয়েছে এবং পূর্ব প্রান্তে একটি উন্মুক্ত মিনি পার্ক রয়েছে। যাত্রীবাহী লঞ্চ সুষ্ঠুভাবে বার্দিং করার সুবিধার্থে নদীর মধ্যে ৪টি টার্মিনাল পন্টুন স্থাপন করা আছে। এ স্থানে লালকুঠি থেকে বুড়িগঙ্গা সহজেই দৃশ্যমান। আবার, বুড়িগঙ্গা থেকেও সহজেই লালকুঠি দেখা যায়। তাই বিআইডব্লিউটিএর বিদ্যমান কোনো স্থাপনার কারণে লালকুঠি দেখা বাধাগ্রস্ত হয় না। এ স্থানে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে উন্মুক্ত পার্কিং ইয়ার্ড ও পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করে এলাকাকে পরিবেশ বান্ধব করা হয়েছে।
তাই নর্থব্রুক হল (লালকুঠি) ভবন সংরক্ষণ ও দৃশ্যমান রাখার জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃক গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিআইডব্লিউটিএর নির্মিত স্থাপনাদি অপসারণের বিষয়ে নৌযান মালিক, যাত্রী সাধারণ ও ব্যবসায়ীদের মতামত পর্যালোচনা করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। 
এ বিষয়ে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল (লালকুঠি) একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। তাই আমরাও চাই পুরনো ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে। তবে সেক্ষেত্রে সবার মতামত থাকা ভালো। যাতে অন্যদের ক্ষতি না হয়। এজন্য ডিএসসিসির কমিটিতে আমরা একজন প্রতিনিধি দিয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকেও আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি।’ লালকুঠির ঐতিহ্য রক্ষার জন্য দুই কমিটি সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিকল্প জায়গা চায় ঢাকা ওয়াসা ॥ নর্থব্রুক হল (লালকুঠি) ভবনটির এক কোণে ঢাকা ওয়াসার একটি পাম্প রয়েছে। এই পাম্প থেকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়। তবে পাম্প হাউসটি স্থানান্তরের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু পাম্পটি স্থানান্তরের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না ঢাকা ওয়াসা। পাম্পটির কারণে লালকুঠির ভবন সংস্কারের সমস্যা হচ্ছে বলে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নর্থব্রুক হলের (লালকুঠি) পুরনো আদল ফিরিয়ে আনার জন্য ইতোমধ্যে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। ভবনের প্রতিটি অংশ আলাদা করে আগের মতোই কাজ করা হচ্ছে। বিশ^ ব্যাংকের অর্থায়নের এই ভবনটি সংস্কার করা হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে ভবন সংস্কারের কাজ শেষ হবে। ভবন সংস্কারে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। পরে দ্বিতীয় ভাগে নদী তীরে ঘাটসহ বিভিন্ন অংশ সংস্কার করা হবে। কিন্তু ওয়াসার একটি পাম্পের কারণে ভবনটি সংস্কারের সমস্যা হচ্ছে। পাম্প সরানোর জন্য একাধিক বার ঢাকা ওয়াসাকে বলা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।’ 
তবে বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা না হলে ওয়াসার পাম্প সরানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ওঅ্যান্ডএম) প্রকৌশলী একেএম সহিদউদ্দিন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পছন্দমতো বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা না হলে পাম্প সরানো সম্ভব নয়। কারণ পাম্পটি একদিনের জন্যও বন্ধ রাখা যাবে না। একটি পাম্প স্থাপনের জন্য ১ কোটি টাকা দরকার হয়। হুট করে বললেই পাম্প হাউস স্থানান্তর করা যায় না। যদি ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বিকল্প জায়গার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমরা তা স্থানান্তর করব।’

×