
কুষ্টিয়ায় ওস্তাদ ভাই লাঠি খেলা বেশ জনপ্রিয়
লাঠি হাতে সারিতে দাঁড়িয়ে ৭০ বছরের লাঠিয়াল আজিজল বিশ্বাস। প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমনে লাঠির কৌশল দেখাতেই আসেন তিনি। দশ বছরের শিশু ইমরানের উদ্দেশ্যও একই। তার হাতেও লাঠি। এভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২৮টি দলের পাঁচ শতাধিক লাঠিয়াল কুষ্টিয়ায় জড়ো হয়েছিল লাঠির এই কসরত দেখাতে। এসব দলে পুরুষের পাশাপাশি ছিল নারী-শিশুও।
খেলায় প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে পাল্টা আঘাত করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন লাঠিয়ালরা। এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল এ খেলা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খেলোয়াড় নেতাদের উদ্যোগে গড়ে উঠত লাঠিখেলার দল। আর পাড়ায় পাড়ায় ও গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হতো লাঠিখেলা। তবে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ খেলাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কালের আবর্তে লাঠিখেলার স্থান আজ দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাটমিন্টন। এ ছাড়া মোবাইলে পাবজি, ফ্রি ফায়ারহ বিভিন্ন ধরনের খেলা। আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রাম-বাংলার হারানো ঐতিহ্যবাহী এই লাঠিখেলাকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে ও বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর ৯০ বছরপূর্তি উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ওস্তাদ ভাই লাঠিখেলা উৎসব ও লোকজ মেলা’। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে ঢাক-ঢোলের বাজনা আর গানের তালে তালে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনদিনের আনন্দময় এ উৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শিশির কুমার রায় বলেন, ‘এই শিকড় (লাঠিখেলা) ধরে রাখতে হবে, হারানো যাবে না, ভুলে যাওয়া যাবে না। নারী-পুরুষ সবারই লাঠির কসরত জেনে রাখা ভালো। তাতে একদিকে যেমন খেলা দেখানো যায়, আরেক দিকে এই কসরতের মাধ্যমে আত্মরক্ষার কৌশলও রপ্ত করা থাকে, যা বিপদে কাজে লাগানো যেতে পারে।’
বর্ষীয়ান লাঠিয়াল আজিজল বিশ^াস বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার শুরুতে ঢাক-ঢোল আর কাঁসর ঘণ্টার তালে তালে চলে লাঠির কসরত। এ সময় প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা ও পাল্টা আঘাত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন লাঠিয়ালরা। এতে উৎসাহ জোগান উপস্থিত দর্শকরা’। এক সময় এ আয়োজনকে ঘিরে গ্রামবাসীর মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। লাঠিখেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন নানা বয়সের দর্শকরা। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এ খেলাটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। লাঠিখেলাকে মূলত লাঠির কৌশল বলা যেতে পারে। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মার্শাল আর্ট-লাঠির দ্বারা এক ধরনের লড়াই যা বাংলাদেশ ও ভারতে অনুশীলন করা হয়। ‘লাঠিখেলা’ অনুশীলনকারীকে ‘লাঠিয়াল’ বলা হয়। এ ছাড়া যারা লাঠি চালনায় দক্ষ কিংবা লাঠি দিয়ে মারামারি করতে পটু বা লাঠি চালনা করে জীবিকা অর্জন করেন; তাদের ‘লেঠেল’ বা ‘লাঠিয়াল’ বলা হয়।
ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গ) নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়ালদের নিযুক্ত করত। চরাঞ্চলে জমি দখলের জন্য মানুষ এখনো লাঠি দিয়ে মারামারি করে। এই খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ লাঠি দিয়ে রণকৌশল প্রদর্শন করেন। শুধু বলিষ্ঠ যুবকরাই এই খেলায় অংশ নিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে যুবক, বৃদ্ধ সব বয়সের পুরুষরাই লাঠিখেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে নারীরাও পিছিয়ে নেই। খেলায় লাঠির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কর্নেট, ঝুমঝুমি, কাড়া ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় এবং সঙ্গীতের সঙ্গে চুড়ি নৃত্য দেখানো হয়। বর্তমানে দেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, নড়াইল, যশোর জেলায় ঈদ কিংবা নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনো লাঠিখেলা প্রদর্শিত হয়। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খেলাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
প্রসঙ্গত, ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কুষ্টিয়ার প্রয়াত সিরাজুল হক চৌধুরী। যিনি ‘ওস্তাদ ভাই’ নামে পরিচিত। তিনি এই খেলাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সারাদেশের লাঠিয়ালদের সংগঠিত করে ১৯৩৩ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী। কিন্তু আর্থিক দৈন্যতাসহ নানা কারণে লাঠিয়ালদের সেইভাবে সংগঠিত করা সম্ভব না হলেও সিরাজুল হক চৌধুরীর পরিবার সংগঠনটিকে টিকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ওস্তাদ ভাই ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন। রেখে যান তার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা।
এদিকে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর ৯০ বছরপূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী ‘ওস্তাদ ভাই লাঠি খেলা ও লোকজ ঐতিহ্য মেলা’ ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে শেষ হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ উপলক্ষে কলেজ মাঠ সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। প্রথম দিন সকালে শতাধিক লাঠিয়াল বাহারি পোশাক পরে লাঠি হাতে শোভাযাত্রা বের করে। কুষ্টিয়া শহর প্রদক্ষিণ শেষে শোভাযাত্রাটি কলেজ মাঠে ফিরে আসে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন লাঠিখেলা ও লোকজ উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি। অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু, উপদেষ্টা সদস্য জিয়া হাসান চৌধুরী রিপন, এসএম কাদেরী শাকিল, সুব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। পরে সাংস্কৃতিক ও লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো দর্শক অনুষ্ঠান দেখতে কলেজ মাঠে ভিড় জমান।
বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু বলেন, ‘৯১ বছর ধরে চৌধুরী পরিবারের শতাধিক নারী-পুরুষ গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা ধরে রেখেছেন। সেই থেকে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী লোকজ ঐতিহ্য রক্ষায় সংগঠনের সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে সাফ গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে লাঠিয়াল বাহিনীর শতাধিক সদস্য লাঠিখেলা প্রদর্শন করেন। তিনি গ্রামীণ ঐতিহ্য এই লাঠিখেলাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
চৌধুরী পরিবারের মনজুরীন সাবরিন চৌধুরী বলেন, ‘দাদার হাতে তৈরি এই লাঠিয়াল বাহিনী। তিনিও দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাঠিখেলা দেখান। নারীরাও যাতে এই খেলা রপ্ত করতে পারেন, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আত্মরক্ষায় নারীরা যাতে কাজে লাগাতে পারেন, এ জন্য দেশের স্কুল-কলেজে লাঠিখেলার কসরত শেখানো প্রয়োজন’।
চৌধুরী পরিবারের রূপন্তি চৌধুরী বলেন, ‘সুখী ও সুন্দর জীবনের জন্য এই খেলাটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। জনপ্রিয়তার মাধ্যমে খেলাটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া বা উঠতি যুব সমাজকে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করা যাবে’। উৎসব উদযাপন কমিটি আহ্বায়ক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো লাঠিখেলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চিত্তকে প্রফুল্ল রাখা। পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে লাঠিয়ালদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা’।