ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

একাত্তরে হানাদার পাকি বাহিনীর নির্মমতা!

কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঘের খাঁচায় প্রাণ দিতে হয়েছিল

এস এম জসিম উদ্দিন

প্রকাশিত: ০০:২৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঘের খাঁচায় প্রাণ দিতে হয়েছিল

বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দীন; ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেড কোয়ার্টার্সের সেই বাঘের খাঁচা

১৯৭১ এ তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন তসলিম উদ্দীন। শখ করে তিনি নিজের বাংলোয় দুটি চিতাবাঘ পুষতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চিতাবাঘ দুটি তাদের ক্যাম্পে (বর্তমান বিজিবি ক্যাম্প) নিয়ে যায়। পরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাঙালিকে জীবন্ত অবস্থায় বাঘের খাঁচায় ফেলে হত্যা করে। 
তেমনি বাঘের খাঁচায় জীবন দিয়েছিল অকুতোভয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দীন। সারা দেশের মতো এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় অত্যাচারের শিকার হয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ। মুক্তিকামী বীর বাঙালির অপরিসীম বীরত্বগাথাও সমুজ্জ্বল হয়ে আছে বর্তমান জেলাটির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের পাতায়। 
 জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুর রহমান বাবলু জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ছিল দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা। এই মহকুমার পীরগঞ্জ থানার কোষারানীগঞ্জ ছিল শহীদ সালাহউদ্দীনের গ্রাম।
শহীদ সালাহউদ্দীনের পরিবার সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় চরম গণহত্যা চালায়। তারা ১৮ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে গণহত্যা চালাতে গিয়ে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ-লুটপাট ও নারী নির্যাতন করে। গণহত্যার ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকেই যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময়ের দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সালাহউদ্দীনও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে অপারেশন শেষে ছুটতে থাকেন একের পর এক এলাকায়।
১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সালাহউদ্দীন পীরগঞ্জের জাবরহাট ক্যাম্পে অবস্থান করেছিলেন। সে সময় একটি দুঃসংবাদ আসে সালাহউদ্দীনের বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেছে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে। এ সংবাদে ভেঙে পড়েন সালাহউদ্দীন। গভীর রাতে একজন সহযোদ্ধাকে জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন তিনি। ১১ থেকে ১২ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সালাহউদ্দীন পৌঁছে যান বাড়ি। ‘মা, মা...’ বলে ডাকতেই খুলে যায় ঘরের দরজার কপাট। পরিবারের সদস্যরা সালাহউদ্দীনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা।
এদিকে সালাহউদ্দীন যখন গ্রামে ঢুকছিলেন, তখন রাজাকাররা তাকে দেখে ফেলে। খবর চলে যায় পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরে। সকাল ১০টার দিকে সালাহউদ্দীনের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। টের পেয়ে সালাহউদ্দীন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারলেন না। সালাহউদ্দীনের মা নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েও ব্যর্থ হন। তবে তিনি ঘর থেকে কুরআন শরিফ এনে ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাবাকে মারবে না, শুধু এটুকু কথা বলে যাও।’ কুরআন ছুঁয়ে ক্যাপ্টেন বলে যান, ‘নেহি মারুঙ্গা উনকো।’
এরপর পাকিস্তানি সেনারা সালাহউদ্দীনকে বন্দি করে নিয়ে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর ক্যাম্পে (বর্তমান বিজিবি ঠাকুরগাঁও সদর দপ্তর)। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের সদর দপ্তর। সেখানে এনে তার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য বের করার চেষ্টা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু সালাহউদ্দীন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তার ওপরে ভয়ংকর নির্যাতন চালাতে শুরু করে সেনারা। প্রথমে ভয়ভীতির পর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নির্যাতনের মাত্রা। চোখের পাতিতে বড়শি বিঁধিয়ে নিষ্ঠুরভাবে টানাটানি করা হয়। তবু অনড় সালাহউদ্দীন। নির্যাতনের একপর্যায়ে কেটে নেওয়া হলো হাতের আঙুল। হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হলো। তারপরও বিন্দুমাত্র টলানো গেল না সালাহউদ্দীনকে।
শেষ পর্যন্ত সালাহউদ্দীনকে ঘিরে এক বর্বর সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানি সেনারা। শহরজুড়ে মাইকে প্রচার চালিয়ে মানুষজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১২ নভেম্বর শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা বন্দি সালাহউদ্দীনকে নগ্ন গায়ে শুধু ফুলপ্যান্ট পরা এবং হাতবাঁধা অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসার মেজর জামানের সামনে আনা হলে তাকে বলা হয়, “হয় তথ্য দাও নতুবা বাঘের খাঁচায় যাও”।
ইতিহাস কথা বলে... ‘বীর সালাহউদ্দীনের জবাব ছিল আমি প্রস্তুত। সেই সময় ক্ষুধার্ত বাঘ দুটো খাঁচার ভেতর ছটফট করছিল, পাক সেনারা উল্লাস করছিল, শহরে মাইকিং করে পাকিস্তানপন্থি দালালদের একত্রিত করা হয়েছিল। সবার সামনে খান সেনারা পেছনে দুই হাতবাঁধা অবস্থায় সেই নির্ভীক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে বাঘের খাঁচায় ছুড়ে দিয়েছিল। 
একটি বাঘ এক পলকেই সালাহউদ্দীনের বুক ও মুখে থাবা বসিয়ে দিল। সালাহউদ্দীন ‘মা, মা...’ বলে চিৎকার দিতেই খাঁচার দুই বাঘ মিলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল তার দেহ। আর এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা উল্লাস করতে লাগল।
সালাহউদ্দীনের চাচাত ভাই ওহিদুজ্জামান বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হত্যার বর্বরতা আর আছে কিনা, তা তার জানা নেই। এ ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নির্মম ঘটনা। দেশের স্বাধীনতার জন্য সালাহউদ্দীন বাঘের খাঁচায় নিজের জীবন উৎসর্গ করলেও আজ সে ঘটনার খুব একটা আলোচনা নেই। বাঘের খাঁচায় সালাহউদ্দীনের জীবন উৎসর্গের ঘটনাটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং ১২ নভেম্বর শহীদ সালাহউদ্দীন দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি করেন তিনি।
পীরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আকতার হোসেন বলেন, ‘শহীদ সালাহউদ্দীনের বীরত্ব নিয়ে অনেক কিছু করার ছিল। কিন্তু আমরা তেমন কিছুই করতে পারলাম না। এটা আমাদের কষ্ট দেয়।’

×