ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

ঐতিহ্য হারাতে বসেছে পূরান ঢাকা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:১৮, ১০ নভেম্বর ২০২৩

ঐতিহ্য হারাতে বসেছে পূরান ঢাকা

হাজারো ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ একটি নাম পুরান ঢাকা

হাজারো ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ একটি নাম পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার জীবন ও সংস্কৃতি ঐশ্বর্যের বাতিঘর। আজকের ঢাকা যান্ত্রিক এক মহানগরী। সেই দিনের ঢাকার জীবন ও সংস্কৃতি বর্তমানে ঐশ্বর্যের বাতিঘর হয়ে আছে। সেই আলোয় আলোকিত রাজধানী ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে দক্ষিণের এলাকাটি আজকের পুরান ঢাকা। ভাষা ও সংস্কৃতি রূপাতীত হয়ে ধরে রেখেছে ঐতিহ্য। বহু পুরাকীর্তি, ইতিহাসের স্থাপত্য নিদর্শন পুরান ঢাকাকে করেছে মহিমান্বিত।

পুরান ঢাকার মানুষের অতিথি আপ্যায়ণ, ভোজন বিলাস, অমায়িক ব্যবহার, বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি অপার শ্রদ্ধা তাদের এক নিবিড় বন্ধনে নিয়ে আসে। পুরান ঢাকা পূর্ব-পশ্চিমে গে-ারিয়া ফরিদাবাদ থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। এক সময় অত্যন্ত সুন্দর, পরিকল্পিত এবং ছিমছাম একটি শহর ছিল পুরান ঢাকা। কিন্তু কালক্রমে সেই সৌন্দর্য ম্লান হয়ে আসছে। অবশ্য এর  পেছনে মানুষই দায়ী। 

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঢাকার নামকরণ নিয়ে বেশকিছু ইতিহাস আছে। রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ওই অঞ্চলে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তাই রাজা বল্লাল সেন মন্দিরের নাম রাখেন ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম হয়ে ওঠে ‘ঢাকা’। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানীরূপে ঘোষণা করেন; তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ নগরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনি লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই নগরের নাম ‘ঢাকা’ হয়ে যায়।
সেদিনের পুরান ঢাকার স্মৃতিকথা বলার লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানের প্রবীণগণ যা বলেন তা পূর্বসূরিদের থেকে জানা। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ পুরান ঢাকাবাসীদের মুসলমানের ঈদ উৎসব, শিয়া মুসলমানদের মহরমের তাজিয়া উৎসব, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা পার্বণ, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উৎসব ছাড়াও পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব, পহেলা ফালগুন, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকত ভর বছর। খাওয়ার আয়োজনে মোরগ পোলাও, বিরিয়াানি, কয়েক ধরনের কাবাব, বাখরখানি, ফালুদাসহ বাহারি কত যে খাবার তৈরি হয় পুরান ঢাকায়।
পুরান ঢাকার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাহন হলো রিক্সা। এই প্রাচীন শহরটির যাতায়াতের পথগুলো অত্যন্ত সরু হওয়াতে রিক্সা এখানকার প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ভারী মালামাল এখন পর্যন্ত বহন করে। 
তবে পুরান ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি অধিক জনপ্রিয়। এটি স্থানীয় মানুষের কাছে টমটম নামে পরিচিত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই ঘোড়ার গাড়ি। অনেক মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার জন্য পুরান ঢাকায় আসে। প্রাচীন কালে যখন যন্ত্রচালিত বাহন ছিল না, তখন মানুষ পশুচালিত গাড়িতে করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করত। শুধু তাই নয়, জমিদার ও নবাবের বাহন ছিল এটি। কিন্তু এটি বর্তমানে শুধু পুরান ঢাকাতে পাওয়া যায়।

প্রাচীন রাজধানী শহর পুরান ঢাকার সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। কিন্তু ভাড়া একটু বেশি লাগে। জনপ্রতি ৩০ টাকা করে ভাড়া লাগে। এতে প্রায় ১০-১২ জন যাত্রী বসতে পারে। আর এই গাড়িতে চড়ার আনন্দ আলাদা। যেখানে মানুষ বাস, রিক্সা, সিএনজি তে করে যাতায়াত করছে, আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। এতে চড়ে আশেপাশের সব দেখা যায়। উন্মুক্ত গাড়িতে বসে খোলা আকাশের নিচে টগবগিয়ে এগিয়ে যায়। তবে রূপকথার গল্পেও অনেক শুনলেও বাস্তবে দেখা যাবে পুরান ঢাকায়। যেমন পক্সিক্ষরাজ ঘোড়া, রাজপুত্রের টগবগিয়ে চলা ঘোড়া। 
পুরান ঢাকার অধিকাংশ স্থানীয় অধিবাসী আদি ঢাকাইয়া। এই অঞ্চলের মানুষজন কিছুটা পৃথক ধরনের ভাষায় কথা বলে। যাকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা বলা হয়। এই ভাষাতেও অনেক আরবি, ফার্সি এবং হিন্দি-উর্দু শব্দের ব্যবহার বেশি। আদি ঢাকাইয়া’রা সুব্বাসিতে ও কথা বলে থাকে। ঢাকাইয়া লোকেরা বুদ্ধিমান ও চতুর, কিন্তু ব্যবহারে অত্যন্ত অমায়িক হয়ে থাকেন। অতিথিদের আপ্যায়নে পুরান ঢাকার লোকেরা দেশে সর্বশ্রেষ্ঠ। ঢাকাইয়া পরিবারে ও মহল্লায় বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানো হয়। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ধর্ম ইসলাম। তারা ঢাকার অন্য অঞ্চলের মানুষের তুলনায় অধিকতর ধর্মসচেতন। আর ঢাকাকে মসজিদের নগরী বলা হয়ে থাকে। নারিন্দার বিনত বিবির মসজিদ সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। 
পুরান ঢাকার মানুষ খেতে খুব পছন্দ করে। আর সারা বাংলাদেশে পুরান ঢাকার খাবার খুবই বিখ্যাত। এখানকার উল্লেখযোগ্য খাবারগুলো হলো- টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শামী কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, শিক কাবাব, দই বড়া, মুরগি বোরহানী, লাবাং ইত্যাদি। এ ছাড়া অন্যান্য মসলাদার খাবার ঢাকাইয়াদের বিশেষ পছন্দনীয়। নান্নার বিরিয়ানি এখানকার সুপরিচিত খাদ্য।  তবে নাজিরা বাজারের হাজী বিরিয়ানি খেতে দূর প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে পুরান ঢাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন নাটক, সিনেমায় হাজী বিরিয়ানির কথা জানা যায়। আর অনেক জায়গায় টিকে আছে বাকরখানির ব্যবসা। এটা শুধু পুরান ঢাকাতে পাওয়া যায়। শাঁখারী বাজারের মিষ্টি স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আগুন পান এখন দেখা যায়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পুরান ঢাকা যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি তারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এখানের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারী শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল এন্ড কলেজ, ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি, পোগোজ স্কুল, তিব্বিয়া হাবিবিয়া ইউনানী মেডিক্যাল কলেজ, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ইত্যাদি। কিন্তু ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ছিল ঢাকার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পুরান ঢাকার সামাজিক বন্ধন ও বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে যে ধুমধাম হয় তা বিরল। তারা পুত্রবধূ ও জামাইকে খুবই সম্মান দেয়। বাহাদুর শাহ পার্ক স্থাপিত হয়েছিল সকল মানুষের সবুজের আচ্ছাদনে ঘুরে বেড়ানো বিনোদন ভূমিতে। শাঁখারিবাজার ছিল সংগীতের যন্ত্রপাতির তৈরির এলাকা। যেখানে গহনা তৈরিও হতো। বাংলাবাজার সর্ববৃহৎ পুস্তুক বিপণিবাজার। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী সব ধরনের বইয়ের প্রকাশ ও পরিবেশনা কেন্দ্র। বড় লাইব্রেরি, ছাপাখানা ঘিরে এই এলাকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখক বুদ্ধিজীবী, ভিড় জমায় বাংলাবাজারে। কাছেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন হাসপাতাল (মিটফোর্ড) গড়ে তোলা হয়। সদরঘাট, লালবাগের কেল্লা, তারা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, আহসান মঞ্জিল, হোসেনী দালান, বড় ও ছোট কাটরাসহ ৮টি থানা নিয়ে গঠিত পুরান ঢাকা। 
কথা হয়েছিল পুরান ঢাকার স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা আমাদের বাপ দাদার ঐতিহ্য ধারণ করেই চলাচল করি। ঢাকাইয়া ভাষাতেই কথা বলি। সকল ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানেই আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে পালন করার চেষ্টা করি। তবে আগের মতো উৎসব অনুষ্ঠান এখন আর তেমন হয় না।

×