
ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও মহামারিও যে প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করতে পারেনি, সেই ল্যুভর জাদুঘর (চিত্রশালা) সোমবার (১৬ মে) বন্ধ হয়ে গেল নিজের কর্মীদের ধর্মঘটে। বিশ্বের সর্বাধিক দর্শনার্থীপূর্ণ এই জাদুঘরের কর্মীরা বলছেন, অতিরিক্ত পর্যটনের ভারে জাদুঘর ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়ছে।
ফ্রান্সের প্যারিসের আইকনিক আই.এম. পেই নির্মিত কাচের পিরামিডের নিচে হাজার হাজার হতবাক দর্শনার্থী, হাতে টিকিট নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন ধরে। কেউ জানে না ভেতরে ঢোকা যাবে কিনা, কেউ জানে না কেন জাদুঘর বন্ধ। এমনই এক পর্যটক কেভিন ওয়ার্ড (৬২), যিনি মিলওয়াকি থেকে এসেছেন, বলেন, ‘এটা যেন মোনালিসার বিরক্ত মুখ—হাজারো মানুষ অপেক্ষা করছে, কোনো ঘোষণা নেই, কোনো দায়িত্বশীল কেউ নেই। মনে হচ্ছে, আজ মোনালিসাও ছুটি নিয়েছেন।’
ধর্মঘটে মুখ থুবড়ে পড়ল মোনালিসার রাজত্ব
সোমবার ল্যুভরের নিয়মিত অভ্যন্তরীণ এক বৈঠকেই হঠাৎ করেই শুরু হয় কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট। গ্যালারির স্টাফ, টিকিট কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীরা একযোগে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের দাবি, অসহনীয় ভিড়, কর্মীসংকট এবং নাজুক কাজের পরিবেশে তাঁরা আর কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না।
ইতিহাসে ল্যুভর এত অল্প নোটিশে, এত জনসম্মুখে হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার নজির খুবই বিরল। ২০১৯ সালে ভিড়জনিত কারণে ও ২০১৩ সালে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগে ধর্মঘট হলেও, সোমবারের ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।
‘মোনালিসা’র মোহে হারিয়ে যাচ্ছে আসল শিল্প
প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার মানুষ কেবল একটি ছবির জন্য ভিড় করছেন—লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’। যারা আসেন, তাদের অনেকেই পাশের টিজিয়ানো ভেসেলিও (টিটিয়ান), পাওলো ভেরোনিজের মতো মহান শিল্পীদের কর্মের দিকে তাকানোর সময়ও পান না।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্যারিসে আসা জি-হিউন পার্ক বলেন, ‘এটা একটা ছবি দেখার অভিজ্ঞতা না। আপনি শুধু মোবাইল ফোন, কনুই আর গরম অনুভব করেন—তারপর ভিড় আপনাকে ঠেলে বের করে দেবে।’
ম্যাক্রোঁর রেনেসাঁ পরিকল্পনা, কিন্তু কত দূর?
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ল্যুভরের জন্য ‘নতুন রেনেসাঁ’ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। এই প্রকল্প অনুযায়ী, ২০৩১ সালের মধ্যে মোনালিসার জন্য আলাদা কক্ষ, নির্ধারিত সময়ভিত্তিক টিকিট, ও নতুন প্রবেশপথ নির্মাণ করা হবে। তবে কর্মীদের অভিযোগ, এই দশ বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে ল্যুভর হয়তো আরও ভেঙে পড়বে।
লুভরের সামনের সারির কর্মী সারাহ সেফিয়ান বলেন, ‘আমরা ছয় বছর অপেক্ষা করতে পারি না। সমস্যা এখন। এখানে শুধু শিল্পকর্ম নয়, যারা এগুলো রক্ষা করেন, তাদের কথাও ভাবতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাক্রোঁ মিউজিয়ামে এসে বড় বড় কথা বলেন, অথচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ গত দশকে ২০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।’
ভবিষ্যত বিনিয়োগ, কিন্তু বর্তমান অনিশ্চিত
২০২৩ সালে লুভরে এসেছেন ৮৭ লাখ দর্শক—যা এর কাঠামোগত সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিদিনের কষ্ট যেন এক পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে কর্মীদের জন্য—অপ্রতুল বিশ্রাম, সীমিত শৌচাগার, এবং গ্রীষ্মের দাবদাহে কাচের পিরামিডের নিচে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের।
এক ফাঁস হওয়া মেমোতে ল্যুভরের প্রেসিডেন্ট লরঁ দে কার্স জানান, ভবনের কিছু অংশ এখন পানি নিরোধক নয়, তাপমাত্রার হঠাৎ ওঠানামা মহামূল্যবান শিল্পকর্মের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, এবং দর্শনার্থীদের ন্যূনতম সুবিধাগুলোও আন্তর্জাতিক মানে পড়ে না।
একটি জাতীয় গৌরব—এখন সংকটে
ম্যাক্রোঁ ২০১৭ সালে তার নির্বাচনি বিজয় ভাষণ দিয়েছিলেন ল্যুভরের সামনেই। আবার ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকেও ল্যুভর ছিল ফরাসি গর্বের অংশ। কিন্তু আজ সেই গর্বের প্রতীক পড়ে আছে অচল অবস্থায়—কর্মী সংকটে, পর্যটনের চাপে, এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার দ্বিধায়।
সূত্র: এপি।
রাকিব