ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

মানবিক উদ্যোগের দৃষ্টান্ত দস্তরখান

রাস্তার ধারে আন্তরিক আপ্যায়ন- অভুক্ত হলে সবাই অতিথি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:১৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রাস্তার ধারে আন্তরিক আপ্যায়ন- অভুক্ত হলে সবাই অতিথি

শাহবাজ ফাউন্ডেশনের মানবিক উদ্যোগ

মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার যে ইতিহাস, সে তো অনেক পুরনো। এখনো একজনেরটা অন্যে মেরে খাচ্ছে। মেরে খাওয়ার খবরই বেশি আসে। তবে অযুত স্খলন এবং বিচ্যুতির মধ্যেও কিছু ভালো উদ্যোগ আশাবাদী করে তোলে আমাদের। তেমনই এক উদ্যোগের নাম ‘দস্তরখান।’ সাধারণ অর্থে দস্তরখান মানে মাদুর, যেটিতে বসে খাবার খাওয়া হয়। এখানে দস্তরখান বিনা টাকায় অনাহারী মানুষকে খাওয়ানোর মানবিক উদ্যোগ। 
দস্তরখানে অভুক্ত যে কেউ অতিথি হতে পারেন। খেতে পারেন পেটপুরে। কিন্তু এ জন্য কোনো টাকা খরচ করতে হয় না। রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডে ফ্লাইওভারের নিচে প্রতিদিন দুপুরে এই খাবারের আয়োজন করা হয়। অসহায় বৃদ্ধ ভিক্ষুক, ছিন্নমূল শিশু, রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, নির্মাণ শ্রমিক বা অভুক্ত পথিকÑ সবাইকে ওয়েলকাম করা হচ্ছে। ছোটখাটো চাকরি, পকেটে টাকা কম, খরচ বাঁচাতে খেতে চলে আসছেন তারাও। নাম পরিচয় জানতে চেয়ে অতিথিদের কাউকে বিব্রত করা হচ্ছে না। ভেদাভেদ করা হচ্ছে না। সবাই সারিবদ্ধভাবে খাবার গ্রহণ করছেন। দুই পাশে ব্যস্ত রাস্তা। কৌতূহলী দৃশ্যটি দিখছেন অনেকে। এদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করা হয় কি? তা হলে আপনিও দৃশ্যটি দেখে মুগ্ধ হবেন।  
জানা যায়, গত ১ জুন চালু করা হয় দস্তরখান। এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে কার্যকম। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, একেক দিন একেক রকম মেন্যুর ব্যবস্থা করা হয়। কোনো  দিন ভাত-মাছ। কোনো দিন মাংস, ডিম বা সবজি। এর বাইরে ডাল থাকে প্রতিদিন। 
ব্যবস্থাপনার কাজটিও বেশ দক্ষ হাতে করেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন রুবা শাহবাজী, হালিমা সুলতানা, শেখ ফাহিম ফয়সাল, মোহতাসিন, ইব্রাহিম, শাওন, রবিউল, ইব্রাহিম খলিল, সাজ্জাদ, আব্দুল্লাহ ওসামা, রিপা, রীনা প্রমুখ। তাদের একজন কাউছার আহমেদ। তরুণ স্বেচ্ছাসেবী জানান, খাবার পরিবেশনার কাজটি করেন তারা সাতজন। বাজার ও রান্নাবান্নার কাজ করেন অন্য তিনজন। সব মিলিয়ে ১২ থেকে ১৫ জনকে নিয়মিত শ্রম দিতে হয়। 
আরেক স্বেচ্ছাসেবী সাজ্জাদ জানান, একসঙ্গে বেশি করে চাল-ডাল কিনে রাখেন তারা। আগের দিন কাঁচাবাজার সারেন। সকাল ৬টা থেকে রান্না শুরু হয়ে যায়। মগবাজারের একটি বাসায় রান্না হয় বলে জানান তিনি। সেখান থেকে পাতিলে করে গরম গরম খাবার নিয়ে আসা হয় নিউ ইস্কাটনে। দুপুর ১টা থেকে সোয়া ১টার মধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৭০ জন খাবার খান এখানে। যতক্ষণ খাবার থাকে, পরিবেশন করা হয়। 
জানা যায়, প্রতিদিন খাওয়াতে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। পুরো টাকাটাই শাহবাজ ফাউন্ডেশন বহন করে থাকে। কিন্তু কে এই শাহবাজ?

জানতে কথা হয় ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ হোসাইন শাহবাজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, শাহবাজ মোহাম্মাদ ভাগলপুরী ছিলেন ভারতের একজন সুফী সাধক। প্রায় ৪০০ বছর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার বংশধরদের একাংশ ঢাকায় চলে আসি। সেটা আরও প্রায় দেড়শ’ বছর আগে। ঢাকার নবাব বাড়িতে বসবাস করতাম আমরা। এই পরিবারের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে ফাউন্ডেশনটি গড়ে তোলা হয়। তার পর থেকে এটি নানা রকম মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

এসব কাজের মধ্যে এখনো অব্যাহত আছে রিক্স্যা-ভ্যান বিতরণ, গবাদি পশু বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু কার্যক্রম। একেবারে সম্প্রতি অনাহারী মানুষকে একবেলা খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে চালু করা হয় দস্তরখান। ইস্কাটনের পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন রূপগঞ্জের ভুলতা ফ্লাইওভারের নিচে একই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ডিসেম্বর নাগাদ সপ্তাহে তিন দিন সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। 

×