ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফেনী-২

আওয়ামী লীগে একক, বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি

ওছমান হারুন মাহমুদ, ফেনী

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২৪ আগস্ট ২০২৩

আওয়ামী লীগে একক, বিএনপিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি

সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ফেনী-২ সংসদীয় আসন

সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ফেনী-২ সংসদীয় আসন। নানা কারণেই আসনটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এক সময়ের সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাত ফেনী এখন শান্তি ও উন্নয়নের জেলা। এই আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের নিজাম উদ্দিন হাজারী। টানা তৃতীয়বারের মতো আসনটিতে নৌকার বিজয় ধরে রাখতে আসনটিতে দৃশ্যত নিজাম হাজারীই একক প্রার্থী আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে, মনোনয়ন পেতে বিএনপির ডজনখানেক নেতা রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে। 
স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে অ্যাডভোকেট রফিকুজ্জামান ভুঞা এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদের রাজনৈতিক জোট স্কপভুক্ত জাসদ (রব) প্রার্থী (ভোটারবিহীন নির্বাচন) জয়নাল আবেদীন (ভিপি জয়নাল) সংসদ সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আরও দুবার  সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের খাজা আহম্মদ, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রয়াত নেতা জয়নাল হাজারী। এর পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনে টানা দুবার এমপি নির্বাচিত হন নিজাম উদ্দিন হাজারী। 
ফেনী-২ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। প্রকাশ্যে কেউ না থাকলেও মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রের সঙ্গে লবিং করছেন আরও কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিম, নাসির উদ্দিন, কাজী ফয়সলসহ বেশ কয়েকজন। 
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল বলেন, ২০০১ সাল পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বশূন্য ও অগোছালো আওয়ামী লীগকে নিজাম উদ্দিন হাজারী নিরলস চেষ্টা করে জেলা সদর থেকে শুরু করে ছয়টি উপজেলায় দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। দলের মধ্যে থাকা সকল অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ঘুচিয়ে আওয়ামী লীগকে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছেন। 
তিনি জানান, এবার জেলার ৪৩টি ইউনিয়ন, ছয়টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভায় তৃণমূলের ভোট নিয়ে চেয়ারম্যান, মেম্বর, মেয়র ও কাউন্সিলর মনোনয়ন ঠিক করে দিয়েছেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছাড়া সবাই নির্বাচিত হয়েছেন। জেলায় নিজাম উদ্দিন হাজারীর জনপ্রিয়তা যে কোনো দলের রাজনৈতিক নেতার চেয়ে ভিন্ন। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করেছেন। করোনার সময়ে ফেনীর ছয়টি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষকে নিজস্ব তহবিল থেকে ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছেন। এ কারণে দলের একক প্রাথী হিসেবে ফেনী-২ আসনে নিজাম হাজারীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নৌকার বিজয় ধরে রাখতে মোটেই বেগ পেতে হবে না। 

ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী বলেন, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে  ফেনীতে যে উন্নয়ন হয়েছে, তার মধ্যে শতগুণ বেশি উন্নয়ন হয়েছে গত ১৩ বছরে। ফেনীবাসী তার সুফল ভোগ করছেন। নিজাম হাজারী নিজের সুখের জন্য সময় না দিয়ে ফেনীর উন্নয়নে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। ফেনীর উন্নয়নে অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগিয়েছেন নিজাম হাজারী। শুধু ফেনী-২ আসনই নয়, পুরো জেলায় উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন নিজাম হাজারী। 
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে এমপি নিজাম হাজারী জানান, ফেনীতে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ব্যাপক উন্নয়ন করে জেলার মানুষের মন জয় করেছেন, তাতে আশা করা যায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ফেনীর তিনটি আসনে নেত্রী যাদের মনোনয়ন দেবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন জেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে তার জয়ের জন্য কাজ করে যাবেন। তিনি জানান, আগামী নির্বাচনেও এই আসন থেকে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।
বিএনপির দলীয় কর্মকা-ে নিস্ক্রিয়তা ॥ ফেনীতে বিএনপির দলীয় কর্মকা-ে নিষ্ক্রিয়তা বিরাজ করছে। শুধু কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বিএনপির অঙ্গ সংগঠনগুলো পালন করার চেষ্টা করে। নেতাদের নিজেদের মতবিরোধের কারণে বেশিরভাগ সময়ে তারা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করে আসছেন।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল জানান, এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। লেভেল প্লেইং ফিল্ড এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না- এমন মেসেজ কেন্দ্র থেকে তাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে গেলে ফেনীতে ৩০-৩৫ জন প্রার্থী দলের কাছে মনোনয়ন চাওয়ার জন্য মাঠে রয়েছেন। দলটির একাধিক নেতা জানান, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দলের ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি উঠেছে। অন্য দল থেকে যোগদানকারী বা আমদানি করা নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়নাল আবদীন ওরফে ভিপি জয়নালকে মনোননয়ন নিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এমনকি শহরে উল্লেখযোগ্য পোস্টার পর্যন্ত লাগায়নি। ভোটের দিন দুপুর ১২টার আগেই সাংবাদিকদের ডেকে তিনি ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনেও ভিপি জয়নাল মনোনয়ন চাইবেন। নির্বাচন প্রসঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আন্দোলনে বিএনপি মাঠে থাকবে। তবে বিএনপি নির্বাচনে গেলে তিনি এই আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন এটা নিশ্চিত। 
বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)  বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু। এ ছাড়া ডজন খানেক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন যারা বিএনপির  আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে তেমন সক্রিয় নন।
বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওয়ান/ইলেভেনের সময় বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন দলেরই সুবিধাবাদী কিছু সংস্কারপন্থি নেতা। সে সময় ফেনীর ভিপি জয়নাল নিজেও সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। এর আগে ভিপি জয়নাল সুবিধা নেওয়ার জন্য জাসদ থেকে বিএনপিতে যোগদান করেছেন। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন। এখন আবার বাইরের থেকে সুবিধা পেলে দল বদল করাটা তার কাছে অসম্ভব কিছু না। যদিও দলের নেতাকর্মীদের কাছে তার তেমন অবস্থান এখন আর নেই। 
অপর একটি সূত্র জানায়, ফেনীতে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনগুলোর নতুন কমিটি করার রূপকার ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু। তিনি ফেনী-১ আসনে নির্বাচন না করলে ফেনী-২  আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। এ আসনের কোথাও জাতীয় পার্টির (জাপা) উল্লেখযোগ্য অবস্থান নেই। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত দলটির নেতাকর্মীরা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতৃত্বশূন্যতার কারণে এই আসনে কে প্রার্থী হবেন তা নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেনি। 
তবে দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য খোন্দকার নজরুল ইসলাম জানান, বিদেশীদের অহেতুক বাড়াবাড়ির কারণে নির্বাচন হবে কি না এি নয়ে সংশয় আছে। নির্বাচন  হলে তিনি এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন। তিনি জানান, সবশেষ ২০১৮ সালের  একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন, কিন্তু মহাজোটের কারণে তাকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়েছে। আগামী নির্বাচনে তিনি ফের মনোনয়ন পাবেন, এ ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী তিনি। 
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর জেলা  আমির  মাওলানা সামছুদ্দিন জানান, ফেনী-২ আসনের জন্য জেলা জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক লিয়াকত আলী ভুঞাকে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা থেকে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার জন্য আসন কমিটি করা হয়েছে। আসন কমিটি নির্বাচন পরিচালনার সাবিক দায়িত্ব পালন করবে।  
ইসলামি আন্দোলন ফেনী শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা একরামুল হক জানান, দলের জেলা শাখার সহ-সভাপতি গাজী এনামুল হক ভুঞা ও জেলা শাখার উপদেষ্টা নুরুল করিম বেলালীকে মনোনয়নের জন্য নির্বাচন করে রাখা হয়েছে। নির্বাচনের আগে সবকিছু বিবেচনা করে একজনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।

×